আশুতোষ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘দিল্লি সিক্স’ এর ‘দিল গিরা দাফাতন’, ‘দম মারো দম’ এর ‘তে আমো’, ‘বডিগার্ড’ এর ‘আই লাভ ইউ’, ‘আইশা’-র ‘সুনো আইশা’। এই সব কটা হিট গানই তো তাঁর গাওয়া।
আজ্ঞে হ্যাঁ। মুম্বইতে হইচই ফেলে দিয়েছেন এই বাঙালি। চিনতে পারলেন না তো? দাঁড়ান। পরিচয় করিয়ে দিই।
প্রথমেই বলি, আশুতোষ গঙ্গোপাধ্যায় নামে কিন্তু তিনি বলিউডে পরিচিত নন। তাঁর বলিউডি নাম অ্যাশ কিং। এ বার কি চেনা লাগছে?
তা হলে বাকিটা শুনুন।
জন্ম, বড় হওয়া: লন্ডন। বিলেতে গসপেল মিউজিক, বা খ্রিস্টীয় ধর্মীয় গান শিখতে শিখতে দেখা এ আর রহমানের সঙ্গে।
তার পর? ঠিকই ধরেছেন। যা হবার তাই হল। দাদু ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্রজেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনে প্রথম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষক। বাবা শঙ্কর গঙ্গোপাধ্যায়। কীর্তন গাইতেন। সহকারী হিসেবে ছিলেন অনিল বিশ্বাস এবং সলিল চৌধুরীর ‘পরখ’ ছবিতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দলে গানও গাইতেন।
ছোটবেলা থেকে গানের পরিবেশেই বড় হয়েছেন। সঙ্গীতের গুরু বাবা-ই। বাবা কীর্তন গাইতেন বলেই কি গসপেল সঙ্গীত শিক্ষা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন? “বাবা বলেছিলেন যদি গানকে সিরিয়সলি নিতে চাই তা হলে গসপেল মিউজিকটা ভাল করে শিখতে হবে। সেখান থেকেই ওটাতে হাতেখড়ি,” বলছেন কিং।
এই শিক্ষার জোর কিং অবশ্য ভালই বুঝিয়েছেন। দুনিয়া-কাঁপানো পপ গায়িকা লেডি গাগা-র সঙ্গেও রেকর্ড করেছেন একখানা গান।
তা, রহমানের সঙ্গে কাজ করবার অভিজ্ঞতাও নিশ্চয়ই বিরল? “তা আর বলতে? ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’-এর লন্ডন প্রিমিয়ারে উনি এসেছিলেন। ওঁর বাড়িতেই আলাপ। তার পরই উনি আমাকে ওঁর চেন্নাইয়ের বাড়িতে ডাকেন। সপ্তাহ দুয়েক ছিলাম ওখানে। তখনই রেকর্ড করি ওম প্রকাশ মেহরার ‘দিল্লি সিক্স’-এর দিল গিরা দাফাতন,” বলছেন কিং।
এর পরই হিটের ঢল। ‘দিল তেরা...’ শুনে অমিত ত্রিবেদী যোগাযোগ করেন কিংয়ের সঙ্গে। ‘আইশা’য় গাওয়ার জন্যে। অবশেষে ‘আইশা’র টাইটেল সং রেকর্ড লন্ডনে। “কলকাতায় ছিলাম এর কিছু দিন পর। এর মধ্যেই প্রীতমের সহকারী অরিজিৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা! প্রীতমের সঙ্গীতে আমি আর ডি বর্মনের সঙ্গীতের ঝংকার পাই। সব থেকে মজার কথা, আমার যে ধরনের গায়কি তাতে আমি কখনওই ভাবিনি যে প্রীতমের গানে ‘ফিট’ করব। কিন্তু আমার প্রতি ওঁর আস্থার জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে,” বলছেন কিং। ‘বডিগার্ড’-এ গান গেয়েছেন, তা সলমন খানের সঙ্গে আলাপ হয়নি? “হয়েছে তো! লন্ডনে ‘বডিগার্ড’-এর সাংবাদিক সম্মেলনে ওঁর পাশেই তো বসেছিলাম। আমাকে ‘বডিগার্ড’-এর গান গাইতে বলা হয়েছিল। গান শুনে সলমন এতই খুশি হয়েছিলেন যে আমাকে আবার একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,” উচ্ছ্বসিত কিং।
পরের সিঁড়ি ‘দম মারো দম’-এর ‘তে আমো’। স্প্যানিশ শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় আমি তোমাকে ভালবাসি। ভাষার কথা বলতে গেলে কিং তো হিন্দি বোঝেনই না! বাংলাতেও খুব সড়গড় নন। তা হলে সঠিক মাত্রায় আবেগ ঢালেন কী করে তাঁর গানে? “যখনই আমি কোনও হিন্দি গান গাই, সেই গানের সুরকার বা ছবির পরিচালককে বলি গানের মানেটা আমায় বুঝিয়ে দিতে। আর, হাজার হোক বাঙালি তো! এটা অনেকটা সে রকম, যেখানে এক জন বাঙালি যে ভাবে ক্লিফ রিচার্ড বা ন্যাট কিং কোল আত্মস্থ করেন। বলতে গেলে এক ভাবে বাঙালি সংস্কৃতির উদারতারই লক্ষ।”
সেই বাঙালি সংস্ক্ৃতির টানে বা আরও নির্ভুল বলতে গেলে নিজের শিকড়ের টানেই কলকাতা এসে বেশ কিছু দিন থেকেওছিলেন কিং। “গত বছর কলকাতা গিয়েছিলাম। আমার বাংলা ছবিতে গান গাইবার খুব ইচ্ছে। বিশেষ করে নচিকেতার সঙ্গে কাজ করার। খুব ছোটবেলায় কলকাতায় এসেছিলাম। বিশেষ কিছু মনে নেই। তবে বাঙালি রান্না দারুণ ভালবাসি। বিশেষ করে মাছ। মহাজাতি সদনে গিয়ে দেখি দাদুর ছবি টাঙানো আছে। ভবানী সিনেমার পাশের গলিও তো ওঁর, মানে বি এল গঙ্গোপাধ্যায়ের নামেই। বাবা থাকতেন টালিগঞ্জে। হৈমন্তী পিসি, মানে হৈমন্তী শুক্লর সঙ্গে আমার খুব জমে। কী অসাধারণ গায়িকা!” বললেন কিং। হৈমন্তী শুক্ল ছাড়া অন্য প্রিয় গায়ক শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী সমরেশ চৌধুরী।
আর সমসাময়িক গায়কদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা? সে সবে বিশ্বাসীই নন কিং। “গায়কি এতটাই একটা স্বতন্ত্র ব্যাপার যে আমার মনে হয় না এটা নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতা হতে পারে। গান হল নিজেকে, নিজের আবেগকে প্রকাশ করার মাধ্যম। আর যাঁরা এটা করে হৃদয়ে হাজার বছর থেকে যান, তাঁরাই নমস্য,” বললেন
আশুতোষ গঙ্গোপাধ্যায়।
ওরফে অ্যাশ কিং। |