ব্যাগ গুছিয়ে...
ডাকছে করবেট
সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার শেষ। সাড়ে ন’টার মধ্যে ফরেস্ট লজ ফাঁকা করে চলে গেছেন ক্যান্টিন-কর্মীরা। আলোও নেই। আকাশে কোজাগরীর ঝকঝকে চাঁদ। সন্ধে থেকে চলা ঝিঁঝির ডাকটা এমন কানে সয়ে গেছে যে মনে হয় সামনের জঙ্গলের নীরবতায় একটুও চিড় ধরেনি। আলোয়ানের মতো গায়ে জড়িয়ে আছে সাদা-সাদা অন্ধকার। সন্ধের দিকে লজের পেছনে নদীর চড়া পেরিয়ে খান চারেক বাচ্চা নিয়ে একদল হাতি ঢুকেছিল এ দিকটায়। প্রচুর গাছ, বাঁশঝাড়। জমিয়ে ভোজ হচ্ছে তাদের বোঝাই যাচ্ছিল। এখন তারাও একটু চুপচাপ।
অর্থাৎ আপাত শান্ত, বেশ একটা স্বর্গ-স্বর্গ পরিবেশ। হঠাৎ...কান ফাটানো আওয়াজ। হাতি-বাচ্চার আর্ত চিৎকার। প্রায় একই সঙ্গে ‘মাঙ্কি কল’। বাঁদরের ডাক। বাঘ কাছাকাছি চলে আসার অব্যর্থ প্রমাণ বলা যায়। নৈঃশব্দ্য ততক্ষণে কুচিকুচি। কিন্তু সেই ডাক, যার জন্য চোখ জ্বেলে, কান পেতে বাংলোর বাইরে আলো নিভিয়ে বসে থাকা, সে ডাক তো এখনও শোনা গেল না?
ভাবতে ভাবতেই হিম-হিম রাতে হাড় হিম করা হুঙ্কারটা এল জঙ্গলের শ্রেষ্ঠ ব্যারিটোন! যাক, শেষ পর্যন্ত তা হলে তিনি আগমন ঘোষণা করলেন!
এক্ষুনি বেরোলে বাঘ দেখতে পাওয়াটা প্রায় জলভাত। প্রায় বলছি কারণ বাঘের সম্বন্ধে কখনওই কিছু নিশ্চিত বলা যায় না। সামনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাফারির জিপ। কিন্তু সূর্য ডোবার পর যে বনবাংলোর হাতার বাইরে পা দেওয়া বারণ! ড্রাইভার রাজিই হবে না “নেহি স্যর। কাল একদম সুবে লে যায়েঙ্গে নদী কে পার...” এদিকে ‘সুবা’ হতে হতে বাঘের ওই নদীর পাড়েই থাকার যে কোনও গ্যারান্টি নেই, সে কথা কে বোঝাবে এই কুমায়ুনীকে?
এত কাছে, তবু এত দূরে!
আসলে এটাই বাঘের পেছনে ছোটার মজা। বা পিছুটান, যাই বলুন না কেন। প্রত্যেক বার আসবেন, প্রত্যেক বার সে আপনাকে ফাঁকি দিয়ে, তাকে দেখার যে থ্রিল, তার ভগ্নাংশের একফোঁটা দিয়ে সরে যাবে, আর আপনার আরও রোখ চাপবে, আপনি আবার ফিরবেন জঙ্গলে, ফরেস্ট লজে মোমবাতির কাঁপা আলোয়, নিরামিষ খাবার আর মশার কামড় (যদি সঙ্গে মশা তাড়ানোর ক্রিম না থাকে) খেয়ে, অপেক্ষা করে থাকবেন হলদে-কালো ডোরার এক ঝলকের জন্য। নেশাড়ুর মতো এই টানের কাছে আত্মসমর্পণএটাও তো এক ধরনের থ্রিল না কি?
তো সেই থ্রিলের স্বাদ নিতেই করবেট ব্যাঘ্রপ্রকল্পের দক্ষিণ প্রান্তে এই ঝিরনা রেঞ্জে আসা। করবেটের ১২৮৮ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে নানা এলাকা। ঢিকালা, সর্পদুলি, বিজরানি, গরজাই এই সব রেঞ্জের নাম। আগে এ সব জায়গায়, জঙ্গলের মধ্যেই গ্রাম ছিল। এখন সে সব উঠে গেছে জঙ্গলের বাফার জোনের বাইরে। কিন্তু নামগুলো থেকে গেছে। ঝিরনাও তাই। “বিজরানিতে স্যরজি, আপনার মতো দু’-রাত জঙ্গলের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকলে বাঘের দেখা পাবেনই। কিন্তু এদিককার বাঘেরা বড্ড লাজুক,” বলেছিলেন রিয়াজ খান। তিন দিনের সফরসঙ্গী ড্রাইভার। সুতরাং রাতের বেলা ওই ডাক শুনেই ক্ষান্ত দিতে হল এ যাত্রায়।
উপায়ও ছিল না। অক্টোবরের একেবারে শুরুতেই চলে এসেছি। এ সময়ে, জঙ্গলের মধ্যে বর্ষার পর পথঘাটের অবস্থা খুব খারাপ থাকে। অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের শুরুর দিকে জঙ্গলের সব রেঞ্জ খুলে যায়। কিন্তু এত আগে ঝিরনার দিকটাই একমাত্র খোলা। আর দু’নম্বর কারণ হল ঝিরনার ফরেস্ট লজে থাকার লোভ। চারখানা ঘর। তার মধ্যে দু’টি তৈরি হয়েছে সেই ১৯০৮ সালে। উঁচু সিলিং, একতলা, দু’টি ঘরের মধ্যে বিরাট লিভিং রুম, ফায়ারপ্লেস, সামনে টানা বারান্দা। হাতায় হরিণ ঘুরে বেড়ায়। একেবারে খাস ব্রিটিশ পরিবেশ। শুধু সাহেবদের সময় এখানে বনমোরগের ঝোল সহযোগে ডিনার হত, এখন উত্তরাঞ্চলের রিজার্ভ ফরেস্টের নিয়ম মেনে নিরামিষ মেনু। এ সময়টা ভিড়ের চাপ কম। তা-ও দু’মাস আগে থেকে রামনগরের ফরেস্ট অফিসে চিঠি পাঠিয়ে, অনেক তদ্বির করে তবে পাওয়া গেছে ঘর দু’খানা।
এমনিতে জঙ্গলের বাইরে রামনগর টাউনে থাকার জায়গার অভাব নেই। সেখান থেকে সকাল-বিকেল সাফারিতে আসা যায় জঙ্গলে। আরও দূরের রেঞ্জগুলোর বাইরেও আজকাল রিসর্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু খাস জঙ্গুলে অভিজ্ঞতা পেতে গেলে ফরেস্ট রেস্ট হাউসই আদর্শ। দু’রাত-তিন দিনের পাস পাওয়া যায়। তার বেশি থাকা যাবে না।
কিন্তু দু’রাতই বা কম কীসে? গভীর জঙ্গলের নিরবচ্ছিন্ন নৈঃশব্দ্য, লেসার ইন্ডিয়ান হর্নবিলের এক ঝলক উড়ে যাওয়া, প্রাচীন বটের মাথা থেকে সবুজ টিয়াঝাঁকের শূন্যে লাফ, গাছের পাতার ঘন পর্দা ভেদ করে ভোর ছ’টার কাঁচা রোদের ফালি ফালি প্যানেলে মাটিতে নেমে আসা, জোড়া হরিণের গা-ঘষাঘষি প্রেম, ফুট চারেক লম্বা পাহাড়ি টিকটিকির অনন্ত ধৈর্যশীল অপেক্ষা, হাতির পালের গায়ে ধুলো মেখে নদীতে নেমে স্নান এ সব স্বর্গের মতো টুকরো দৃশ্য তো মুঠোমুঠো ছড়ানো আছে গোটা করবেট জুড়ে।
আর বাঘের দেখা না-ই বা পেলেন, ওয়াচটাওয়ারে বসে তার গল্প শোনাও তো একটা অভিজ্ঞতা। যে জানোয়ার এমনই মাস্তান যে হরিণের পালের মধ্যে একটাই হরিণকে শিকার ঠিক করে। তারপর দৌড় শুরু করে থাবার কাছে অন্য হরিণকে পেলেও ধরে না। যাকে তাক করেছে, তাকে না পেলে শিকার ছেড়ে দেয়। উপোস যায়, সে-ও ভি আচ্ছা। যে জানোয়ারের হুঙ্কার শুনে তার জন্মশত্রু হনুমান স্রেফ হার্টফেল করে নাকি গাছের নীচে পড়ে যায়। আর বাঘও তাকে জলখাবারের মতো খেয়ে ফেলে।
সেই হুঙ্কারই তো শুনেছিলাম বনবাংলোয়, রাতের বারান্দায় বসে। বাঘ দেখা দেয়নি ঠিকই, কিন্তু আমন্ত্রণ তো রেখেছিল আবার ফিরে যেতে।

করবেট যাওয়ার সেরা সময়
ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে করবেট পৌঁছনোর টানা ট্রেন নেই। দিল্লি হয়ে যেতে হবে।
গাড়িতে পৌঁছতে ঘণ্টা দশেক লাগে। রাতের ট্রেন আছে। রানিখেত এক্সপ্রেস। রামনগর পৌঁছয় ৫টা নাগাদ।
বাঘ স্পটিংয়ের সেরা এলাকা
বিজরানি, ঢিকালা। স্রেফ জঙ্গুলে অনুভূতির জন্য যদি যান, তা হলে ঝিরনার জবাব নেই।
কোথায় থাকবেন

জঙ্গলের মধ্যে সাবেক রেস্টহাউসের আস্বাদ পাবেন বিজরানি আর ঝিরনা, দু’জায়গাতেই। ফরেস্ট রেস্ট হাউসে
থাকলে বিকেল পাঁচটার মধ্যে জঙ্গলে ঢুকে পড়তে হবে। তার পর গেট বন্ধ হয়ে যায়। তার আগে রামনগরের
ফরেস্ট অফিস থেকে পাস জোগাড় করতে হবে। জঙ্গলের বাইরের যে কোনও রিসর্টেও থাকা যায়। হোটেলে
থাকলে সাফারির পাসের ব্যবস্থা ট্র্যাভেল ডেস্ক করে দেবে। জঙ্গলের ভিতরে একমাত্র সাফারি জিপ
যেতে দেওয়া হয়। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে, তা রামনগরেই রেখে যেতে হবে।
রামনগর ফিল্ড ডিরেক্টরের অফিসের নম্বর (এখান থেকেই ফরেস্ট রেস্ট হাউসগুলির বুকিং হয়)

এসটিডি কোড-০৫৯৭, ফোন: ২৫৩৯৭৭, ২৫১৪৮৯, ২৫১৩৭৬। এ ছাড়া বেসরকারি হোটেল বুকিংয়ের
সময়েই সাফারির কথা বলে নেবেন। কারণ একবেলায় জঙ্গলে গাড়ি ঢোকার সংখ্যার উপর কড়াকড়ি আছে।
সঙ্গে রাখুন
মশা তাড়ানোর ক্রিম। টর্চ ও ওষুধ রাখাও জরুরি।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.