মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। গত তিন দিনে বিদর্ভে ছ’জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী উমেন চান্ডিরও দুশ্চিন্তার কারণ একই। তাঁর রাজ্যেও কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। এই প্রবণতা রুখতে তাঁকে এক ডজন কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়েছে।
এত কৃষকের আত্মহত্যার কারণ কী? তাঁরা চাষের জন্য ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু তার পরে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বা বিক্রি না হওয়ায় দেনায় ডুবে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তথা বাণিজ্য মহল মনে করছে, বিদেশি লগ্নির ফলে খুচরো ব্যবসা আরও সংগঠিত হলে, কৃষক আত্মহত্যাও কমবে। কী ভাবে? বিদেশি সংস্থাগুলি খুচরো ব্যবসায় নামলে চাষিদের ফসল বিক্রি করার বিকল্প পথ তৈরি হবে। চাষিরা এখন যে সব ফড়ে বা দালালকে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন, অভাবের সময় তাঁদের কাছেই ধার করে বসেন। খুব বেশি সুদে নেওয়া সেই ধার চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে এবং তা শোধ করতে চাষিরা ওই দালালদের কাছেই খুবই কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। তাতে আয় বাড়া তো দূরের কথা, উল্টে দেনায় ডুবতে থাকেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় সরকারের যুক্তি, খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি এলে তারা সরাসরি চাষিদের থেকে ফসল কিনবে। প্রয়োজনে তারাই চাষিদের সার বা বীজের মতো জরুরি উপকরণের বন্দোবস্ত করে দেবে। ফসল বিক্রি না হওয়ার চিন্তাও তখন থাকবে না।
সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চেঙ্গাল রেড্ডির যুক্তি, “অন্ধ্রে কৃষকরা ফসল বিক্রি করতে না পেরে একটা মরসুম চাষ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মহারাষ্ট্রে কৃষকরাও ফসল বিক্রি করতে না পেরেই আত্মহত্যা করছেন। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি এলে ফসল বেচার নতুন নতুন সংস্থা তৈরি হবে।” তাঁর দাবি, এত দিন যে সব ফড়ে বা দালালরা ‘পরজীবী’-র মতো চাষিদের ‘রক্ত শুষতেন’, তাঁদের পিছু হটতে হবে। অর্থাৎ, দালালরাজ মুছে যাবে।
সত্যিই কি দালালরাজ শেষ হবে? খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির বিরোধীদের দু’টি যুক্তি রয়েছে। সিপিএম নেতা নীলোৎপল বসুর যুক্তি, “সব দালালকে হটিয়ে ওয়ালমার্ট বা টেসকো-র মতো সংস্থাগুলিই বড় মাপের সংগঠিত মধ্যসত্বভোগী হয়ে উঠবে। চাষিদের অবস্থা বদলাবে না। তাঁরা সেই কম দামই পাবেন। ক্রেতাদেরও বেশি দাম দিতে হবে। মাঝখানের যে অংশটা বিভিন্ন স্তরের ফড়েদের মধ্যে ভাগ হত, এ বার সেই পুরো লাভের গুড়ই যাবে বহুজাতিক সংস্থার ঝোলায়।” দ্বিতীয় যুক্তিটি হল, আসলে এই দালালরাও কোথাও যাবেন না। খুচরো ব্যবসায় নামা বহুজাতিক সংস্থাগুলি চাষিদের থেকে ফসল কিনতে সেই দালালদেরই কাজে লাগাবে। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, বিরোধীদের যুক্তিগুলি পরস্পরবিরোধী। এক দিকে বহু মানুষ রোজগার হারাবেন বলে তাঁরা সরব হচ্ছেন। দালালরাও কাজ হারাবেন। কিন্তু তাঁদের যদি বিদেশি সংস্থাগুলি নিয়োগ করে, তাতেও আবার বিরোধীদের আপত্তি। যদিও এতে আসলে লাভই হবে। কী ভাবে? মন্ত্রক কর্তাদের যুক্তি, সংগঠিত খুচরো ব্যবসা এখনও এ দেশে নতুন ক্ষেত্র। বহুজাতিক সংস্থাগুলি সেখানে পুঁজির পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। কিন্তু গ্রামের কোথায় কোন ফসল হয়, চাষের ধরন, স্থানীয় ক্রেতাদের পছন্দ-অপছন্দ তাদের অজানা। সে সব আবার এই দালালরা হাতের তালুর মতো চেনেন। এই দুইয়ের সমন্বয় পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় আরও পেশাদারি দক্ষতা নিয়ে আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে এত দিন যাঁরা দালালির কাজ করতেন, তাঁরাও রোজগার হারাবেন না। তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে বহুজাতিক সংস্থাগুলি।
বামেদের মতো বিদেশি লগ্নির কট্টর বিরোধীরা এ-ও বলছেন, নতুন ব্যবস্থায় চাষিরা দালালদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে বহুজাতিকগুলির খপ্পরে গিয়ে পড়বে। প্রথমে চাষিদের বাগে আনতে তারা সার-বীজ দেবে, ফলন বাড়ানোর উপায় বলে দেবে। এই ভাবে তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যাতে চাষিরা ওই সংস্থাকেই ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবে। আবার বিদেশ থেকে সস্তায় ফসল মিললে তখন এই বহুজাতিকগুলিই বাইরে থেকে তা আমদানি করবে। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতে না পেরে তাঁরা তখন বিপদে পড়বেন। বাণিজ্য মন্ত্রকের শিল্প নীতি দফতরের সচিব পি কে চক্রবর্তীর প্রশ্ন, “এ দেশের সরবরাহ ব্যবস্থায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করার পর বিদেশি সংস্থাগুলি আবার জাহাজ ভাড়া দিয়ে বাইরে থেকে কেন পণ্য আমদানি করতে যাবে? ন্যূনতম ১০ কোটি ডলার লগ্নির অর্ধেকটাই এ দেশে সরবরাহ ও মজুত ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করার পর, তারা এখান থেকেই পণ্য কিনতেই উৎসাহিত হবে।”
মন্ত্রকের কর্তাদের আরও বক্তব্য, খুচরো ব্যবসায় এখন যে সব সংস্থা রয়েছে, চাষিদের থেকে শাকসব্জি, ফসল কেনার পরেও তাদের চাহিদা থেকে যায়। তখন তাদেরও পাইকারি বাজারে যেতে হয়। বিদেশি লগ্নির আসার ফলে আরও অনেক সংস্থা ব্যবসায় নামবে। কে চাষিদের বেশি দাম দেবে, কে বেশি সুবিধা দেবে, তার প্রতিযোগিতাও শুরু হবে। যাতে লাভবান হবেন চাষিরাই। এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার ফসল ঘরে তুলবেন। মন্ত্রক সূত্রের যুক্তি, চাষিদের মধ্যে যে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পৃথ্বীরাজ-উমেন চান্ডির কপালে, তা-ও সহজ হওয়া কঠিন হবে না। |