সঙ্কটকে সুবিধায় বদলে ফেলতে বদ্ধপরিকর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।
ইউপিএ-র প্রথম অধ্যায়ে পরমাণু চুক্তি নিয়েও কংগ্রেসে ভ্রূকুটি ছিল। ভয় ছিল সংখ্যালঘু ভোট হারানোর। কিন্তু ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই ভয় ভেঙে দিয়ে মনমোহন সিংহ-সনিয়া গাঁধী প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, ভারতীয় জনসমাজের বড় অংশই পরমাণু শক্তির পক্ষে।
কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব আজ বলছেন, ইউপিএ-র দ্বিতীয় অধ্যায়ে মনমোহন সিংহ আবার রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছেন। এ বারও সনিয়া-মনমোহনের বোঝাপড়া চূড়ান্ত: খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি লগ্নির সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটার প্রশ্নই নেই। বরং বিরোধী দল এমনকী, শরিকদের একাংশের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হবে। তাতে যদি দেশে অকাল নির্বাচন হয় তো হোক। বিরোধী নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মুলতুবি প্রস্তাবে রাজি আছি। কিন্তু এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।
মুলতুবি প্রস্তাব যেন এক ছদ্মবেশী অনাস্থা প্রস্তাব। মুলতুবি প্রস্তাবে হেরে গেলে সংবিধান অনুসারে সরকারের পতন হয় না। কিন্তু ভোটের ফলে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে মনস্তাত্ত্বিক ভাবে এবং নৈতিক দিক থেকে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়বে। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি দুর্বল কংগ্রেসকেই চায়। তবে তাদের সামনেও বড় প্রশ্ন, এখনই কি তারা ভোটে যেতে প্রস্তুত?
আগামী বুধবার লোকসভার অধিবেশন বসলে সরকার মুলতুবি প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে দেবে। সংসদীয় মন্ত্রী পবন বনশল বলেন, “মুলতুবি প্রস্তাবে সম্মতি না দিলে বিরোধীরা যদি সংসদ চালাতে না দেয়, তা হলে বরং সম্মতি দিয়ে সংসদ চালাতে ইচ্ছুক আমরা। ভোটের ফলাফল যা-ই হোক, নীতির প্রশ্নে আমরা অনড়।”
খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি লগ্নির বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসের এই মনমোহনী রাজনীতি কিন্তু এত দিন অনুপস্থিত ছিল। বরং কংগ্রেস ও সরকারের মধ্যেই একটি মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন মনমোহন সিংহও দলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, লোকসভায় পাটিগণিতের সঙ্কট রয়েছে ঠিকই। কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পারলে কংগ্রেস এ ব্যাপারে কৃষক ও উপভোক্তা মধ্যবিত্তের সমর্থন পাবে। আর তাই এখন দুর্বলতাকে রাজনৈতিক সুবিধায় রূপান্তরিত করতে চাইছে কংগ্রেস। দুর্নীতি-লোকপাল থেকে কালো টাকা সব বিষয় সরিয়ে রেখে তারা আপাতত বিদেশি লগ্নিকে প্রচারের বড় হাতিয়ার করতে চাইছে। ইউপিএ-র সাড়ে সাত বছর পরে ঠিক এই সময়টায় চিড় ধরছিল মনমোহন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতায়। মনমোহন সিংহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অভিযোগ তোলা হচ্ছিল, তিনি এক জন দুর্বল প্রধানমন্ত্রী। ঠিক সেই সময় খুচরোয় বিদেশি লগ্নি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তাতে অটল থাকার হিম্মত দেখালেন মনমোহন। সেই হাওয়াকেই এখন কাজে লাগাতে চাইছে কংগ্রেস। দেশ জুড়ে যে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিরাট সংগঠিত আন্দোলন তৈরি হয়েছে, এমনটাও চোখে পড়ছে না কংগ্রেস নেতাদের। তাঁরা মনে করছেন, সংগঠিত ব্যবসায়ী-দোকানদার ভোটারদের মধ্যে বিজেপির একটি সীমাবদ্ধ প্রভাব থাকলেও দেশ জুড়ে মধ্যবিত্ত-আমজনতার মধ্যে এই সিদ্ধান্তের পক্ষেই সমর্থনের হাওয়া।
সাধারণত পৃথিবীর সব দেশেই সরকার এবং শাসক দল নীতির প্রশ্নে হাতে হাত ধরে চলে। কিন্তু ভারতে নরসিংহ রাও সরকারের সময় থেকে গত দু’দশক ধরে চিত্রটি অন্যরকম। ’৯১ সালে মনমোহনের অর্থনীতি ছিল বিশ্বজনীন বাধ্যবাধকতা। কিন্তু কংগ্রেস সে দিনও এই উদারবাদকে সমালোচনার চোখে দেখেছিল। উল্টো দিকে বাম রাজনীতিকরা আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্কের জনবিরোধী আর্থিক নীতির সমালোচনায় মুখর ছিলেন। ঠিক সে ভাবে না হলেও কংগ্রেসও কিন্তু, সময়ের দাবি মতো আর্থিক সংস্কারকে মেনে নিলেও, দলগত ভাবে এই নীতির প্রশ্নে যথেষ্ট অস্বস্তির মধ্যে ছিল। ইউপিএ-র প্রথম অধ্যায়ে যে হেতু বাম সমর্থন নিয়ে সরকার চালানোর প্রশ্ন ছিল, তাই দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারে হাত দিতেই পারেননি মনমোহন। কিন্তু তাতে সনিয়া গাঁধী যে বিশেষ অখুশি হয়েছিলেন, তা-ও নয়। বরং বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের জন্য আরও বেশি চাপ দিচ্ছিলেন সরকারকে। আমআদমির সরকার হয়ে ওঠার চেষ্টাও ছিল কংগ্রেসের।
বরং এনডিএ জমানায় অটলবিহারী বাজপেয়ী আর্থিক সংস্কারের প্রশ্নে অনেক বেশি কঠোর ছিলেন। সঙ্ঘ পরিবারের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে যশোবন্ত সিংহ এবং যশবন্ত সিন্হা বিদেশি লগ্নি নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ ছাড়াই এগিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, লোকসভা নির্বাচনে ‘ভারত উদয়ের’ স্লোগান দিয়ে শহুরে মধ্যবিত্তের মন জয় করতে পারবেন। ‘ফিল-গুড’ অনুভূতিকে মূলধন করে ফের ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু তাঁদের সেই ঝুঁকি বুমেরাং হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত সেই ব্যর্থতার ফলেই সঙ্ঘ পরিবার এখন অনেক বেশি বিজেপির উপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের মনোভাবটা হল, বিদেশি লগ্নি বা সংস্কারের বাড়াবাড়ি আর নয়। ফিরে চলো পুরনো স্বদেশিয়ানার স্লোগানে।
কংগ্রেসে কিন্তু চিত্রটি বদলে গিয়েছে। কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ইউপিএ-র দ্বিতীয় অধ্যায়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সনিয়া-মনমোহনের মতান্তরও প্রকট হয়েছে বেশ কয়েক বার। এ বারও সনিয়া-রাহুল প্রথম অর্ধে নীরব ছিলেন। উল্টে মন্ত্রিসভায় অ্যান্টনি-জয়রাম এই সিদ্ধান্তের সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলায় অনেকের মনে হয়েছিল, তবে কি সনিয়া গাঁধী মনমোহনের পিছনে নেই? কিন্তু পরে দেখা গেল মনমোহন সনিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও হীনমন্যতা রাখা উচিত নয়। কারণ, এই সিদ্ধান্তে ফড়ে তথা দালালদের হাত থেকে চাষিদের মুক্ত করা যাবে। ওয়ালমার্ট বা ক্যারফোর ইতিমধ্যেই ভারতে দেশি সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে ব্যবসা করছে। কিন্তু এখন তারাই ন্যূনতম ৫১ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে। এর ফলে এ দেশের উপভোক্তারা আরও লাভবান হবে। চিনের মতো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেও বহু ব্র্যান্ডে খুচরো বিক্রয়ে বিদেশি সংস্থা ব্যবসা করছে কয়েক দশক ধরে। এমনকী, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি ইন্দিরা জমানার জাতীয়করণের রাজনীতির সময়কার রাজনীতিক, তিনিও আজ এই বিদেশি লগ্নির পক্ষে সব থেকে বড় প্রবক্তা। কারণ জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন, একশো দিনের কাজের মতো প্রকল্পের জন্য বাজেটে তাঁকে কোটি কোটি টাকার জোগান দিতে হবে। অথচ দেশে এখন আর্থিক মন্দা, মূল্যবৃদ্ধি, শেয়ার বাজারের দুর্বল স্বাস্থ্য। তাই প্রণববাবুও এই বিদেশি লগ্নিকে এনে বিনিয়োগের আবহ সৃষ্টিতে অতি-সক্রিয়।
কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করছেন, নব্বইয়ের দশকে ম্যাকডোনাল্ডস বা কেএফসি যখন ভারতে এসেছিল, তখনও তার বিরোধিতা হয়েছিল। কিন্তু এখন এ দেশে পিৎজা এবং ধোসা একসঙ্গে ঘর করে। শিঙ্গাড়া ও বার্গারের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। আর তাই পঞ্জাবের কৃষকরা এখন স্বাগত জানাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রেও সে ভাবে বিরোধিতা হচ্ছে না। বরং কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন, এর ফলে এ দেশে শহুরে বেকারদের চাকরির সুযোগ বাড়বে। আর নানান ধরনের ব্র্যান্ডের জিনিস যদি বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়। মনমোহন সিংহ তাই মনে করছেন, যদি ভারতের এই সুপ্রাচীন দলটি রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত না করে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখাতে পারে, তা হলে হয়তো রাজনৈতিক ফায়দার ফসলটাই ঘরে তোলা সম্ভব হবে। |