কোথাও নদীর বাঁধ কাটা হচ্ছে। কোথাও আবার সরকারি অনুমোদন ছাড়াই নদীর বুক থেকে তোলা হচ্ছে বালি। এমনকী তার বিনিময়ে ‘চালান’-ও দিচ্ছে বালি মাফিয়ারা।
কাটোয়া মহকুমা জুড়ে পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন যে তড়িঘড়ি প্রশাসনিক বৈঠক ডাকতে বাধ্য হয়েছেন জেলাশাসক। মঙ্গলবার কাটোয়া গিয়ে মহকুমাশাসক দেবীপ্রসাদ করণম এবং ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে তিনি বৈঠক করেন। কী কী বেআইনি কাজের অভিযোগ তিনি পেয়েছেন, বৈঠকে তা সবিস্তার তুলে ধরেন তিনি। সেই সঙ্গে কিছু ‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’র উল্লেখও তিনি করেছেন। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, আধিকারিক ও কর্মীদের দুর্নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির জন্য মহাকরণে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।
তবে এতেও যে দুর্নীতি পুরোপুরি আটকানো যাবে, সে আশা বস্তুত কেউই করছেন না। কারণ ভূত যে সর্ষের মধ্যেই, তা সকলেই জানেন। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের কর্মী এমনকী আধিকারিকদের বিরুদ্ধে বালি মাফিয়াদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ বারবার উঠেছে। শুধু বালি ব্যবসাই নয়। জমির শ্রেণি পরিবর্তন বা মালিকের নাম পরিবর্তন করা নিয়েও রয়েছে ভুরি ভুরি দুর্নীতির অভিযোগ। বালি মাফিয়াদের কেন বাধা দেওয়া হয়নি জানতে চেয়ে কাটোয়া মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক আবুল আলিমকে ‘শো-কজ’ করা হয়েছে। সম্প্রতি কাটোয়া ১ ব্লকে দু’টি পেট্রোল পাম্পের জন্য জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতেও তিনি ঘুষ নেন বলে অভিযোগ। তার জন্যও তাঁকে ‘শো-কজ’ করা হয়। আবুল আলিম বলেন, “মহকুমাশাসক শো-কজ করেছিলেন। জবাব দিয়েছি।” যদিও মহকুমাশাসক সেই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। |
কী ভাবে হয় চুরি?
সরকারি অনুমোদন ছাড়াই নদীর চর থেকে বালি তোলে মাফিয়ারা। ভূমি দফতরের যে কর্মী ও অফিসারদের নজরদারি চালানোর কথা, তাঁরা সব জেনেও চোখ বুজে থাকেন। পুলিশের কাছেও কোনও খবর যায় না। সেই বালি জেলা ছাড়াও পাশের বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে চালান যায়। নজরদারি ঠিকঠাক চললে রাস্তায় চেকপোস্টেই চোরাই বালির লরি ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানেও কর্মীদের ‘কানা’ করে রাখার ব্যবস্থা পাকা। ফলে ভুয়ো চালান দেখিয়ে সহজেই পার পেয়ে যাওয়া যায়। সম্প্রতি নিজেই অতিরিক্ত বালি বোঝাই লরি ও ট্রাক্টর ধরতে গিয়ে মহকুমাশাসক ‘আবিষ্কার’ করেন, সব লরির চালান ভুয়ো! এর পরেই খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, সে সময়ে মহকুমায় যতগুলি জায়গা থেকে বালি তোলা হত, তার কোনওটিরই বৈধ অনুমতি ছিল না।
তার পরেও অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কেতুগ্রামের চড়খি থেকে ভাণ্ডারগড়িয়া পর্যন্ত অজয়ের পাশে এক্স-জমিনদারি বাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে কিছুটা অংশ ময়ূরাক্ষী সেচ প্রকল্পের মধ্যে পড়ে। কেতুগ্রাম ২ ব্লকের বিল্লেশ্বর, রসুই, ত্যাওড়া গ্রামে বাঁধটিকে কেটে ফেলেছে বালি মাফিয়ারা। সম্প্রতি বিল্লেশ্বর ও ত্যাওড়া গ্রামের বাসিন্দারা বিভিন্ন স্তরে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, এক্স-জমিনদারি বাঁধ এমনিতেই নড়বড়ে। ফি বছর বর্ষায় বাঁধ ভাঙার উপক্রম হয়। রাত জেগে বাঁধ রক্ষা করা এক প্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে বাঁধ কেটে বালি নেওয়া হয়েছে। ফলে এলাকার বাসিন্দাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। সম্প্রতি ত্যাওড়া গ্রাম থেকে ট্রলি সমেত একটি ট্রাক্টর আটকও করা হয়। কেতুগ্রাম ২-এর বিডিও হেমন্ত ঘোষের অভিযোগ, “ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর আমাদের কিছুই জানায়নি। বিশেষ সূত্রে খবর পেয়ে এলাকায় গিয়ে দেখি, ভয়ানক ব্যাপার। বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরি করে বালি মাফিয়ারা রাজত্ব করছে।” বাঁধ কাটার ঘটনায় ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিককে শো-কজও করা হয়েছে।
কিন্তু এ রকম একটা-দু’টো শো-কজ কী মাফিয়ারাজ বন্ধের জন্য যথেষ্ট? |