সরকার মাল্টিব্র্যান্ড রিটেল ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকে ছাড়পত্র দিয়েছে। এতে যে বিনিয়োগ আসবে, তাতে প্রচুর নতুন চাকরি তৈরি হবে। তার চেয়েও জরুরি, এই বিনিয়োগের একটি অংশ যাবে পরিকাঠামোর উন্নতিসাধনে ফলে, রিটেলের জোগান প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রাখতে পরিকাঠামোর উন্নতি হবেই। কৃষকদেরও উপকার হবে। তাঁরা ফসলের জন্য বেশি দাম পাবেন, উপরন্তু তাঁদের কাছে নতুন প্রযুক্তি, উন্নত মানের বীজ ইত্যাদি পৌঁছবে। কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা খুব কম সুদের হারে ঋণও পাবেন।
আন্তর্জাতিক রিটেল ব্যবসায়ীরা ভারতে দোকান খুললে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীদেরও লাভ। তাঁদের পণ্য, যেমন কসমেটিকস, টয়লেটারিজ, পোশাক, চর্মজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য, মশলা, আচার ইত্যাদি এই বড় রিটেল ব্যবসায়ীরা কিনে নেবেন। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই স্থানীয় পণ্যগুলি কিনে তা নিজস্ব (প্রাইভেট) ব্র্যান্ডের নামে বেচলে সংস্থাগুলির খরচ কম পড়ে। আবার, যে বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি এই পণ্য বেচে, তাদের সঙ্গে দর-কষাকষিতেও সুবিধা হয়। সব মিলিয়ে, এই জাতীয় পণ্যের দাম কমবে। তাতে ক্রেতার লাভ। মূল্যস্ফীতির ওপরও তার সুপ্রভাব পড়বে।
পশ্চিমবঙ্গে এমন ছোট ও মাঝারি মাপের পণ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা অনেক। রাজ্যে আন্তর্জাতিক রিটেল সংস্থাগুলি এলে এই ছোট ব্যবসায় চাহিদা বাড়তে বাধ্য। অন্য দিকে, নতুন দোকানগুলিতে প্রচুর কর্মসংস্থানও হবে। পশ্চিমবঙ্গের কুটির শিল্পে যে বিপুল সম্ভাবনা আছে, তার কথাও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মহল জানতে পারবে। কুটির শিল্পজাত পণ্যের জন্য রফতানির দরজা খুলে যেতেই পারে।
রিটেল ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ এলে তাতে আপত্তি কেন? মানুষের মনে কিছু আশঙ্কা আছে।
এক) ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি যেমন করেছিল, এই বিদেশি বিনিয়োগ ঠিক সেই ভাবেই ভারতকে আবার উপনিবেশে পরিণত করবে।
দুই) পাড়ার মুদিখানা চালিয়ে যে মানুষগুলো বেঁচে আছেন, বিদেশি পুঁজি তাঁদের সম্পূর্ণ কর্মচ্যুত করবে।
তিন) এখন ভারতে খুচরো ব্যবসার সঙ্গে প্রায় চার কোটি মানুষ জড়িত বিদেশি পুঁজি এলে এদেরও আর কাজ থাকবে না।
চার) এই বিদেশি সংস্থাগুলি গোড়ার দিকে সব জিনিসের দাম এমন কমিয়ে রাখবে যে ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবে আর তার পর এই সংস্থাগুলি যথেচ্ছ দাম বাড়িয়ে মানুষকে ঠকাবে।
পাঁচ) বিদেশি সংস্থাগুলি বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যই বেচবে, ফলে দেশের সংস্থাগুলি লাটে উঠবে।
প্রথম কথা, এটা ১৬১২ সাল নয়। এখন আর ভারত কয়েক হাজার ছোট দেশীয় রাজ্যের সমষ্টিমাত্র নয়। যে দেশগুলি থেকে রিটেল সংস্থাগুলি ভারতের বাজারে আসবে, তাদের মধ্যে এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদে আর কোনও দেশই আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের তুলনায় বেশি শক্তিধর নয়। ফলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ভূত নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।
দ্বিতীয়ত, পাড়ার যে মুদিখানা নিয়ে ভয়, সেগুলি গত এক দশক ধরেই বড় পুঁজির প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে। স্পেন্সার্স, ট্রেন্ডস, বিগ বাজার, ডি এল এফ এবং সাহারার মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়াই করে তারা টিকে তো আছে। অভিজ্ঞতা বলছে, বড় পুঁজির ব্যবসা আর পাড়ার মুদিখানা দুটোই এক বাজারে পাশাপাশি টিকে থাকতে পারে, কারণ মানুষ দু’ধরনের দোকানেই জিনিস কিনতে যান। আলাদা জিনিস, অবশ্যই। দেশের বড় পুঁজিকে যেমন এই পাড়ার মুদিখানার সঙ্গে লড়ে বাজারে টিকে থাকতে হয়েছে, বিদেশি পুঁজির ক্ষেত্রেও লড়াই তার চেয়ে সহজ হবে না।
হিসেব বলছে, ভারতে এখন রিটেল বাজারের আয়তন ৪৯,০০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। আগামী কুড়ি বছরে তা বেড়ে এক লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছবে। এখন এই বাজারে বড় ব্যবসার হিস্যা মাত্র চার শতাংশ। কুড়ি বছর পরে তা ১৬ শতাংশে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, বাজারের ৮৪ শতাংশ তখনও ছোট ব্যবসায়ীদের জন্যই থাকবে। বিপুল বাজার!
তৃতীয় কথা, যেখানে বাজারের ৮৪ শতাংশ ছোট ব্যবসার দখলেই থাকছে, সেখানে বড় মাপের কর্মসংস্থানহীনতার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর, বড় রিটেলে অপেক্ষাকৃত উঁচু মানের চাকরি তৈরি হবে।
চতুর্থ কথা, খুব রকম দাম কমিয়ে বাজার থেকে প্রতিযোগীদের হঠিয়ে দেওয়া তখনই সম্ভব, যখন কোনও সংস্থার একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার থাকে। বিদেশি রিটেল সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে সেই প্রশ্নই নেই। দেশের প্রতিযোগী সংস্থাগুলির কথা যদি ছেড়েও দিই, বাজারে অনেক বিদেশি সংস্থা থাকবে। তাদের অনেকেরই ভারতীয় অংশীদার থাকবে। সব ক’টি সংস্থাই এই বাজারে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়বে। তার ওপরে দেশের কম্পিটিশন কমিশন বাজারের দিকে নজর রাখবে। ফলে, দাম কমিয়ে বাজার দখলের খেলা সম্ভব নয়।
পঞ্চমত, বিদেশি রিটেল সংস্থা সব পণ্যই বিদেশ থেকে আমদানি করবে, এমন আশঙ্কা সম্ভবত অমূলক। কারণ, বিদেশের বাজারে সব পণ্যের দামই ভারতীয় পণ্যের তুলনায় কম হবে, এমন হওয়া মুশকিল। তবুও, বিদেশি সংস্থাগুলি দোকানের মোট পণ্যের কত শতাংশ আমদানি করতে পারবে, আর কত শতাংশ পণ্য তাদের দেশের বাজার থেকে কিনতে হবে সেটা নিয়ম করে বেঁধে দেওয়া সম্ভব। তাতে দেশের পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির দুশ্চিন্তা কমবে। ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য। তার নিয়ম অনুসারে, দেশের হোক বা বিদেশের, যে কোনও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এই দেশে এক নিয়ম প্রযোজ্য হবে। ফলে, আমদানির পরিমাণ বাঁধার নিয়ম করলে তা শুধু বিদেশি সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
মুশকিল হল, এই দেশের বিভিন্ন বণিক সংগঠন, এবং সেগুলির মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিছু অমূলক আশঙ্কা বাজারে ছড়াচ্ছে। এই আশঙ্কাগুলির মধ্যে একটি বাদে আর কোনওটারই ভিত্তি নেই। দেশের রিটেল ক্ষেত্রটির সংস্কার হলে তা ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। টেলিকম বিপ্লবের মতোই।
দ্য ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-র সেক্রেটারি জেনারেল |