সম্পাদক সমীপেষু...
উন্নয়ন চলছে, কিন্তু প্রান্তিকরা তার শরিক তো?
মাওবাদী সমস্যা আজ আর কোনও বিশেষ অঞ্চল বা জেলা বা রাজ্যের নয়। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। যা ১৯৯৫ সালে কেবল দুটি রাজ্যের ১৫টি জেলায় সীমাবদ্ধ ছিল, তা ২০০৫ সালে ১৩টি রাজ্যের ১৪৬টি জেলায় বিস্তৃত হয়। আর আজ তা ১৭টি রাজ্যের ২০০টিরও বেশি জেলায় ছড়িয়েছে। তিরুপতি থেকে পশুপতি অর্থাৎ অন্ধ্র থেকে নেপাল পর্যন্ত রেড করিডর তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে ১৫০০ কোটি টাকার এক সমান্তরাল অর্থনীতি। এ সমস্যা সমাধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি চেষ্টা করছে থানা থেকে সস্তায় চাল, বিনামূল্যে সাইকেল, স্পেশাল পুলিশে চাকরি ইত্যাদি বিবিধ প্যাকেজের টোপ দিয়ে। অপর দিকে গ্রেহাউন্ড বা কোবরা বাহিনী, যৌথ বাহিনী আর অপারেশন গ্রিনহান্ট-এর আক্রমণ দিয়ে। কিন্তু এ সব করে মাওবাদীদের প্রভাব যে আদৌ কমেনি তা স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট। প্রশাসন এখনও সেই পুরনো উন্নয়নের আশ্বাস ও দমননীতির নিষ্ফলা কৌশলেই এদের মোকাবিলা করতে চাইছে। এ রাজ্যের বর্তমান ও প্রাক্তন মুখামন্ত্রীও ব্যতিক্রম নন। তাই মনে হয়, মাওবাদী সমস্যা শুধুমাত্র অনুন্নয়ন দিয়ে মাপলে ভুল হবে। কারণ, গত ছয় দশকে অনেক উন্নয়নের কাজ হয়েছে।
আবেদন। রেশন কার্ড চাই। লালগড়, ২০০৯ । ছবি: দেবরাজ ঘোষ
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে ধারাবাহিক ভাবে বহু উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু, অনুন্নয়ন নয়, সমস্যা উন্নয়নের অভিমুখ নিয়ে। কারণ, এই উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে সবচাইতে বেশি বলি হয়েছে এ দেশের আদিবাসী জনতা। গত ছয় দশকে সারা দেশে প্রায় ৬ কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষ এই উন্নয়নের শিকার হয়েছে। আর এই মানুষদের ৭৯ শতাংশের বেশি এই আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায়।
অনস্বীকার্য, ‘বিনাশ ছাড়া বিকাশ হয় না’। কিন্তু যে মানুষেরা ক্রমাগত বিনাশের যন্ত্রণা সহ্য করবেন তাঁরা বিকাশের সুফল থেকে চিরকাল শুধু দূরে থাকবেন তা-ই নয়, উপরন্তু ওই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁরাই ব্রাত্য থেকেছেন। আজকের মাওবাদী সমস্যার শিকড় এই ধারাবাহিক বঞ্চনার মধ্যেই প্রোথিত আছে। শুধু মাত্র গত এক দশকেই ঝাড়খন্ড, ছত্তীসগঢ়, অন্ধ্র আর ওড়িশাতে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ১৪ লক্ষ মানুষকে উৎখাত করে প্রায় ১২ লক্ষ একরের বেশি জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যা আয়তনে কেন্দ্রশাসিত দিল্লির প্রায় ২৮ গুণ। লক্ষণীয়, এ দেশে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার গত দুই দশকে আদিবাসী জনতার উপর এই আক্রমণ আরও তীব্রতর হয়েছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাওবাদী কার্যকলাপ। সুতরাং একে একটি ক্রিয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা উচিত। কোনও রাজনৈতিক দল এদের বঞ্চনার প্রতিবাদে, অধিকার রক্ষার লড়াইকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের মূল ধারায় যোগ করার চেষ্টা করেনি। উল্টে অনেকেই আদিবাসী জনতার ধারাবাহিক বিস্থাপনকে উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া হিসাবেই দেখেছেন। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে মাওবাদীরা। এই আদিবাসী জনতার কাছে শুধু জীবনধারণ নয় এদের কাছে আরও বড় নিজেদের স্বার্থে উন্নয়নের অভিমুখ নির্ধারণ ও উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা এবং অংশীদারী। মাওবাদীরা আদিবাসী জনতার এই আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার করছে আর আদিবাসী জনতার শোষণমুক্তির কথা বলে বৃহৎ কোম্পানিগুলি থেকে কোটি কোটি টাকার তোলা আদায় করছে। গরিব গ্রামবাসী শ্রমিক কর্মচারীদের থেকে জোর করে লেভি আদায় করছে। আর শ্রেণিসংগ্রামের নামে নির্বিচারে হত্যালীলা চালাচ্ছে, যা কখনওই বিপ্লবী জনযুদ্ধ নয়। এক দিকে প্রশাসন, অপর দিকে মাওবাদী এই দুইয়ের মাঝে হিংসার বলি হচ্ছে আদিবাসী জনতা।
কিন্তু এ সবের বাইরেও যে সত্যিকারের বিকল্প উন্নয়ন সম্ভব, তার মডেল তো শংকর গুহনিয়োগী, বিনায়ক সেন, হিমাংশু কুমারদের মতো সমাজকর্মীরা হাতে-কলমে করে দেখিয়েছেন। ছত্তীসগঢ়ের গ্রামীণ মানুষ ও খনি-শ্রমিকদের নিজেদের উদ্যোগে ও সক্রিয় অংশগ্রহণে নিজেদের পয়সায় তৈরি হয়েছে শহিদ হাসপাতাল। সমস্যা হল, উন্নয়নের এই মডেল শাসকদলের গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এতে বিশ্বব্যাঙ্ক, এ ডি বি তথা দেশি-বিদেশি পুঁজির স্বার্থ রক্ষিত হয় না। তাই এই সব আন্দোলনের নেতাদের ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে হয় খতম করছে বা হাজতে পাঠাচ্ছে। ফলে, রোজ নতুন মাওবাদী তৈরি হচ্ছে। তাই এই শাসকদের পক্ষে বিকল্প উন্নয়নের জনমুখী মডেল ভাবাও অসম্ভব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.