দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে মহিলাদের যোগদানের ক্ষেত্রটি আরও সম্প্রসারিত হইতেছে। স্থির হইয়াছে, যোদ্ধার কাজ ছাড়া বাহিনীর আর সব ধরনের কাজেই মহিলাদের অংশগ্রহণ যেমন স্বাগত, তেমনই ওই সকল কাজে মহিলারা স্থায়ী কমিশনও ভোগ করিতে পারিবেন। অর্থাৎ মহিলারা এই বার দেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী চাকুরির সুযোগও পাইবেন। ইহা নিঃসন্দেহে একটি ভবিষ্যমুখী পদক্ষেপ। দীর্ঘ দিন ধরিয়া এই দাবি উঠিতেছিল। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের সাংবিধানিক রক্ষাকবচের যুক্তিতেই মহিলারা দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হইতে তাঁহাদের নির্বাসিত রাখার প্রতিবাদ জানাইতেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সেই দাবি মানিয়াছে।
বিশ্বের সব দেশেই অবশ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় মহিলাদের অংশগ্রহণের পথে নানা বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনী বলিতে গেলে পুরুষতন্ত্রের শেষ অভেদ্য ঘাঁটি। অন্য সব ঘাঁটি যেখানে সমানাধিকারের মতাদর্শ এবং নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলনে একে-একে ধূলিসাৎ হইয়াছে, তখন শারীরিক সক্ষমতার স্বাভাবিক উৎকর্ষে বিশ্বাসী পুরুষ এই শেষ ঘাঁটিটি রক্ষা করিতে প্রাণপণ চেষ্টিত। ‘মেয়েরা আবার যুদ্ধ করিবে কি, উহারা তো বড়জোর চুলোচুলি করিতে পারে’ ইত্যাকার তুচ্ছতাচ্ছিল্যের নেপথ্যে মহিলাদের যোগ্যতা সম্পর্কে যে একপেশে, অবৈজ্ঞানিক ধারণা নিহিত, তাহাই মহিলাদের জন্য দীর্ঘ কাল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কেবল চিকিৎসা ও শুশ্রূষার কাজটি আলাদা করিয়া রাখিত। যেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হওয়াই মহিলাদের একমাত্র নিয়তি, লক্ষ্মীবাই হওয়া নয়। অথচ মানবসভ্যতার ইতিহাস যুদ্ধবিগ্রহ সহ শারীরিক কষ্টসহিষ্ণুতার যাবতীয় কর্মেই মহিলাদের সদর্থক যোগদানের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। ক্রমে অনেক দেশেই জাতীয় প্রতিরক্ষার কাজে মহিলাদের অংশগ্রহণ অনুমোদিত হইয়াছে। মিলিটারি নার্স ছাড়া অন্যান্য সামরিক পেশাতেও মহিলারা স্থান করিয়া লইয়াছেন। এ জন্য সর্বত্রই অনেক ব্যঙ্গবিদ্রুপ, ঈর্ষাকাতরতা, কটুভাষণ, এমনকী শারীরিক লাঞ্ছনা ও মানসিক নিগ্রহও পুরুষ সহকর্মীদের কাছে তাঁহাদের সহ্য করিতে হইয়াছে। কিন্তু সে সকল বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করিয়া দৃঢ়তা ও সঙ্কল্পের জোরে তাঁহারা নিজেদের অধিকার ও যোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। দেখাইয়া দিয়াছেন, পুরুষরা যাহা পারে, সুযোগ পাইলে মহিলারাও তাহা পারেন, হয়তো পুরুষদের চেয়ে ভাল ভাবেই পারেন।
সত্য, এখনও বিশ্বের দুই-একটি ব্যতিক্রমী রাষ্ট্র ছাড়া কোথাও মহিলাদের সরাসরি যোদ্ধার কাজে নিয়োগ করা হয় না। ইহার পিছনেও মহিলাদের ‘দুর্বলতা’ সংক্রান্ত পিতৃতান্ত্রিক ধারণা ও অতিকথাটিই সক্রিয়। ধনতন্ত্র, এমনকী সমাজতন্ত্রে উন্নীত হইলেও মহিলাদের অপকর্ষ বিষয়ক সামন্ততান্ত্রিক কুসংস্কারটি অধিকাংশ পুরুষ এখনও সযত্নে লালন করে। আর রাষ্ট্র ও তাহার প্রধান শক্তি প্রতিরক্ষা বাহিনীও যেহেতু ভয়ানক ভাবে পিতৃতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত, তাই সশস্ত্র বাহিনীতে যোদ্ধা, ফাইটার বিমানের পাইলট কিংবা যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেনের পদগুলি পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত রহিয়াছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যদি ভারতীয় নারীর সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করেন কিংবা মহিলা বৈমানিকদের দক্ষতা ও কৃতকার্যতার হিসাব লন, তবে রণক্ষেত্রে যোদ্ধার ভূমিকাতেও এক দিন ভারতীয় মহিলাদের দেখা যাইতে পারে। নিজে গর্ভধারণে অক্ষম হইলেও দত্তক পুত্রের মাতৃত্ব পালনে লক্ষ্মীবাইয়ের কোনও অসুবিধা হয় নাই। কিন্তু সেই পুত্রকে যখন ঝাঁসির সিংহাসন হইতে বঞ্চিত করা হইল, তখন বঞ্চনাকারী ইংরাজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়া ঘোড়সওয়ার হইতেও তাঁহার ক্ষণমাত্র দ্বিধা হয় নাই। ভারতবাসীর মুখে-মুখে তাই আজও শুনা যায় খুব লড়ি মর্দানি, ওহ্ তো ঝাঁসিওয়ালি রানি। |