তেল নয়, এখন দেশকে বেশি বেগ দিচ্ছে ডলার। তেলের দাম বাড়লে যে তা সব মানুষকে ছুঁয়ে যায়, এ কথা আমাদের জানা ছিল। কিন্তু ডলারের দাম বাড়লে যে তা প্রায় একই রকম ভাবে প্রত্যেককে আঘাত করে, তা এ বারই প্রথম স্পষ্ট হল। গত কয়েক মাসে ভারতীয় মুদ্রায় মার্কিন ডলারের দাম ৪৪ টাকা থেকে বেড়ে, উঠে এসেছে ৫২ টাকায়। শতাংশের হিসাবে কমবেশি ১৮ শতাংশ। এই বৃদ্ধির খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে।
যা আমরা আমদানি করি, তার প্রায় সব কিছুরই দাম বেড়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি অর্থাৎ ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যহ্রাসের তালে তালে। যে বিপুল পরিমাণ তেল আমরা আমদানি করি, তার বেশির ভাগের দামই আমাদের মেটাতে হয় ডলারে। তেল কোম্পানিগুলি শেষ যে তেলের দাম বাড়িয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বাড়ার কারণে নয়, টাকার তুলনায় ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে।
যে-সব খাদ্যপণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়, তাদেরও দাম বেড়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। এর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে ভোজ্য তেল। রাসায়নিক সার আমদানির খরচও বেড়েছে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে। তবে শুধু ডলার নয়, সম্প্রতি ভাল রকম বিনিময়মূল্য বেড়েছে ইউরো এবং স্টার্লিং পাউন্ডেরও। এর প্রতিকূল প্রভাব পৌঁছে যাচ্ছে ভারতীয়দের ঘরে ঘরে।
এই ব্যাপারে একটি প্রশ্ন অনেকেরই মনে জাগছে এবং তা হল ইউরোপ এবং মার্কিন অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়া সত্ত্বেও ডলার, ইউরোর দাম বাড়ছে কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের দিকে তাকাতে হবে। পশ্চিমী অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ায় ভারত থেকে তাদের বহু পণ্যের আমদানি কমেছে। অর্থাৎ রফতানি কমছে ভারতের এবং বৈদেশিক মুদ্রা কম আসছে আমাদের হাতে। অন্য দিকে আমদানি তো কমেইনি, বরং বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ বেরিয়ে যাচ্ছে বহুমূল্য বৈদেশিক মুদ্রা। শেয়ার বাজারে বিদেশি লগ্নি বেশ কমে আসায় ডলার প্রবাহ কমেছে ভারতে। অর্থাৎ আয়ের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রায় খরচ এখন বেশি। চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার জোগান কম হওয়ায় দাম বেড়েই চলেছে ডলার, পাউন্ড ইউরোর। ভবিষ্যতে আরও খারাপ দিন আসতে পারে এই আশঙ্কায় সরকার তার তহবিল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ছাড়ছে না, সংরক্ষণ করছে। এই রকম যদি চলতে থাকে, তবে পাউন্ড ডলারের দাম আরও বাড়বে। এক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের আশঙ্কা, ডলারের দাম বেড়ে পৌঁছে যেতে পারে ৫৮ টাকায়। তা যদি হয়, তবে তা আদৌ ভাল হবে না দেশের সাধারণ মানুষের জন্য।
এ বার একনজরে দেখে নেওয়া যাক, বৈদেশিক মুদ্রার তুলনায় টাকার দাম কমায় কী ধরনের প্রভাব পড়ছে শিল্প ও সাধারণ মানুষের উপর।
• বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে বেশি খরচ হচ্ছে।
• বেশি খরচ হবে কয়লা আমদানি করতে। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বাড়বে।
• রাসায়নিক সারের দাম বাড়বে, যা আঘাত করবে কৃষি ক্ষেত্রকে।
• আমদানি করা জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাড়বে।
• দাম বাড়বে ভোজ্য তেলের।
• আমদানি করা গাড়ির যন্ত্রাংশের দর বেশি পড়ায় দাম বাড়বে গাড়ির।
•একই কারণে দাম বাড়বে ইলেকট্রনিক মেশিন এবং অত্যাধুনিক টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদির।
• দাম বাড়বে আমদানি করা খেলনা ইত্যাদির।
• খরচ বাড়বে সেই সব অভিভাবকের, যাঁরা ছেলেমেয়েকে বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছেন। ডলার কিনে পাঠাতে এখন অনেক বেশি খরচ পড়বে প্রতি মাসে।
• খরচ বাড়বে বিদেশ ভ্রমণেরও।
• লাভ কমবে আমদানি-নির্ভর বেশির ভাগ সংস্থার। এর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে শেয়ার বাজারে।
• দাম বাড়বে চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কিছু যন্ত্রের।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনে ডলার পাউন্ডের উত্থান-পতনের প্রভাব এখন বিরাট। এটাই বিশ্বায়ন। এর সুফল অবশ্য ভোগ করছেন কেউ কেউ। যেমন আগে একজন অনাবাসী ভারতীয় দেশে ১০০ ডলার পাঠিয়ে বিনিময়ে পেতেন ৪,৪০০ টাকা। এখন পাবেন ৫,২০০ টাকা। দেশে সুদের হার যথেষ্ট ভাল থাকায় এঁরা বেশি করে টাকা দেশে পাঠাতে উৎসাহিত হবেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ ভাবে লাভবান হবে রফতানি প্রধান সংস্থাগুলি। বিশেষ করে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলি। বিদেশে আয় করা ডলার দেশে ভাঙালে এঁরা আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি টাকা হাতে পাবেন। এঁদের অবশ্য চিন্তা বিদেশে ব্যবসা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি একটুও সুখকর নয়। না সরকারের পক্ষে, না সাধারণ মানুষের কাছে। |