|
|
|
|
বিকেলের ফুচকা
জীবনের জরুরি খুচখাচ |
জীবাণু-অধিকৃত আঙুল, চটকে চটকে আলু মাখা, কনুই ডুবিয়ে তেঁতুলজলের খোঁজ,
তার পর শালপাতায় জন্ম নেন ঈশ্বর। ঝালে-ঝোলে-অম্বল-এ ফুরিয়ে আসছে ফুচকা। ঋজু বসু |
শতাব্দী-প্রাচীন সেই ধ্রুপদী মিষ্টির দোকানের কত্তামশাই কদাচ সন্দেশ স্পর্শ করেন না।
এমনিতে কোন সন্দেশে কোন পুর কতটা দিতে হবে বা ছানার পাকে কোন ভুলে কী পরমাদ চোখ বুজে বলে দেবেন। কিন্তু সন্দেশ জিহ্বায় ধারণ করতেই তাঁর প্রখর আপত্তি। জানতে চাইলে শুধুই রহস্যময় হাসি।
এক সন্ধেয় কিছু বিশেষ টোটকা প্রয়োগের পরে কিঞ্চিৎ আলগা তুরীয় মেজাজে তাঁর এই ‘অপারগতা’-র কারণ জানা গেল। খানিক ‘কিন্তু-কিন্তু’-র পরে, এক ভয়ানক ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ জবাব।
বললেন, ‘‘সন্দেশ তো আর গ্লাভস পরে মাখা যাবে না, তা বলে ওই কেলে-কেলে হাত দিয়ে প্যাঁক-প্যাঁক করে মেখে মেখে দেয়, ও জিনিস কারও খেতে রুচি হয় বলুন।” বোঝো!
এ হেন তীব্র শুচিবায়ুগ্রস্ত পিটপিটে মিষ্টি-বাবুটি পর্যন্ত নির্ঘিন্নে হয়ে ফুচকাওলার জার্মস মাখা পাঁচ আঙুলের অতি ‘ঘনিষ্ঠ’ আলুর পুর ভরপুর সৃষ্টি গপগপিয়ে সাবাড় করে ছাড়েন। শালপাতায় ‘পুষ্পবৃষ্টি’র প্রাক-মুহূর্তে তেঁতুলজলের জালায় কী এক মুঠো মশলা ছুড়ে ফুচকাওলার কনুই অবধি ডুবিয়ে অদৃশ্য ম্যাজিক-হাতল ঘোরানোর মতো কসরতের পরে জিভের সজল হয়ে ওঠা কে ঠেকাবে? তাই ফুচকায় নিয়ম নাস্তি। ভারতীয়দের হাত দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া নিয়ে বিলিতি টিভি-তে পর্যন্ত মুণ্ডপাত হয়ে গিয়েছে, বিয়ে-বাড়ির কেটারার ইয়া লম্বা গ্লাভ্স এঁটে ফুচকা পরিবেশনের মাধ্যমে আমাদের ভব্য করার কত চেষ্টা করে গেল, তবুও সনাতন অ-সংস্কৃত ফুচকা এ কালেও যত্ত সব হতচ্ছাড়া পরিবর্তনের মুখে ছাই দিয়ে রোঁয়া ফুলিয়ে টিকে আছে। |
|
উত্তমকুমার বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পপুলারিটি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু ফুচকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ক-থা হবে না। কৈশোরের গোপন ফ্যান্টাসিতে তিনি ছিলেন, আবার বহুজাতিক ফুড চেনের জমানাতেও মধ্যজীবনে ভুঁড়ি কমানোর প্রতিজ্ঞা তুড়ি মেরে উড়িয়ে, ফুচকার পতাকা দিকে দিকে পতপতিয়ে উড়ছে। প্যাসিফিক-পারের দেশে থিতু এক বাঙালিনিকে বিনিদ্র রাতে (ইন্ডিয়ান টাইম দুপুর সাড়ে ১২টা-একটা) সাইবার-ওয়ালে ‘এনে দে এনে দে ফুচকা’ লিখে ‘উইদ্ড্রয়াল সিম্পটমে’ কাঁদতে দেখেছি। আবার ফুটপাথের ফুচকাতেই পাশবালিশ জড়িয়ে শুয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন-দেখা এ দেশের নিরীহ মধ্যবিত্তের সহজে ‘ডি-ক্লাস্ড’ হওয়ার আ-রাম। রাজার ঘর টু টুনির ঘর— সব্বাই ফুচকার জন্য হেদিয়ে মরছে।
সেকেলে মাটির কুঁজো বাতিল করে ঘরে-ঘরে ঢককিয়ে মিনারাল ওয়াটারের বোতল ডাঁই করার মতো কিছু পরিবর্তন অবশ্য ফুচকার সাজগোজেও হয়েছে। কোনও উটকো থিম-পার্টির ভদকা-ভরা ফুচকা নিয়ে মাঝেমধ্যে হইচই হয়। ফুচকার গর্ভে মরক্কান সুজি কুসকুস বা চিংড়ি-চিকেনের পুর ঢুকিয়ে তা তেঁতুলজলের বদলে স্প্যানিশ টমেটো সস গাসপাচোয় ডুবিয়ে এক্সপেরিমেন্টও কবেই দেখে ফেলেছে কলকাতা। কিন্তু ফুচকাটা ফুচকার মতো হওয়াই বোধ হয় বাঞ্ছনীয়। ইদানীং দই ফুচকাটা বেশ চলছে। বিউলির ডাল-বেসনটেসনের কী সব বড়া ভরে যে বেজাতের মিষ্টি ফুচকা আজকাল দেখা যায়, খানদানি ফুচকাখোররা তাকে ফুচকা বলেই মানবেন না।
দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত শহরের দীর্ঘ ফুচকা-সেশনে ফুচকাওলার করকমলের বিচিত্র মুভমেন্ট নিয়ে কূট লোকে কুকথাও বলে বটে। প্রকৃত রসিকের তাতে বয়ে গিয়েছে। প্রাজ্ঞ হংসের মতো পরিপার্শ্বের যাবতীয় অতিরিক্ত-অনাবশ্যককে মুহূর্তে এডিট করে তিনি অনায়াসে সার-বস্তু বুঝে নেবেন। অন্য যে-কোনও সুখাদ্যকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা যেতে পারে। তার রেসিপি-প্রযুক্তি নিয়ে থিসিস লেখা হোক গে। কিন্তু ফুচকার সামান্য আয়োজন অসামান্য হয়ে ওঠার নেপথ্যে শুধুই সেই আটপৌরে মানুষী হাতযশ। প্যাকেট-বন্দি গোলগাপ্পা তো দেশ-বিদেশে সবখানে মেলে। তবু ‘রেডি টু মিক্স’ পানিপুরী মশলা কিনে বাড়িতে ফুচকা সৃষ্টির হাস্যকর ব্যর্থতা নিয়মিত ঘটে চলেছে। একলব্যের শরসন্ধান যেমন তার বুড়ো আঙুল বিনা অভাবনীয় তেমনই ফুচকাকেও, স্রষ্টার কল্যাণহস্তের থেকে আলাদা করে ভাবা যায় না। |
|
আমাদের টালাপার্কের পুরনো ফুচকাওলা জয়হিন্দ সাউয়ের ছেলে দীনেশ চোখের সামনে শিক্ষানবিশ থেকে লায়েক হয়ে উঠল। অতীতের ভ্রাম্যমান মোড়া-বাক্সবাহী পর্যায় পার করে সে এখন পার্কের পিছনে নির্দিষ্ট পয়েন্টে প্রতিষ্ঠিত ‘ছত্রপতি’। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে ১০টা অবধি যেন জগদ্দল পাথর। চক্রব্যূহের রথী-মহারথীর মতো তাকে সতত ঘিরে-রাখা জটলার পাড়ার মেয়েরা বৌদি হয়ে উঠলেন, বৌদিরা মাসিমা, কিন্তু দীনেশের পেশাদারিত্বে সেই মধ্যগগনের আঁচ। কে নুন বেশি খাবে, কার ঝাল কতটুকু দরকার— সব ডেটা মগজের কম্পিউটারে বয়ে হাসিমুখে যাবতীয় এক যাত্রায় পৃথক ফল সে সামলে চলেছে। মেয়েরা ‘কাল ঠিক পেট জ্বালা করবে’ অনুশোচনার ফাঁকেও গাড়ির হেডলাইটবিদ্ধ বনহরিণীর মতো এই অমোঘ আকর্ষণে জখম।
নাগাড়ে যান্ত্রিক পরিবেশন ও খুচরো ফেরতের ফাঁকে আর আছে অব্যর্থ হিউমার। এক সঙ্গে কয়েক মুঠো লঙ্কাকুচি আলুতে মেশাতে দেখে সভয়ে তাকালে সে হেসে বলে, ভয় নেই এ হল আয়ুর্বেদিক লঙ্কা। তার স্পেশাল ফাউয়ে ধনে না জিরের গোপন মশলা ছড়িয়ে নেবু চিপে দেওয়ার ফাঁকে কপট-গাম্ভীর্য: হুঁঃ বাবা, এ মশলাটা হচ্ছে কাঠগুঁড়ো। রোজকার একঘেয়ে কাজের মধ্যেও লোকটা এত আনন্দ কোথায় পায় কে জানে! ফুচকা মাখতে মাখতে যেন আপনমনে গাওয়া সুরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছেন কোনও গানওলা। |
|
সন্ধের প্রাইম-টাইম পেরিয়েও চড়া টিআরপি-র ব্যস্ত মানুষটিকে প্রশ্ন করি, তোমার কি চা-ফা খাওয়ারও দরকার পড়ে না? হাত চলতে চলতেই দীনেশের হাসিমুখে জবাব: ধুর, আমি তো জল খেতেও উঠি না! অষ্টপ্রহর চিপকে থাকা মহিলাদের ভিড়ে সব প্রশ্ন অবশ্য করাও মুশকিল।
জাত-শিল্পীর তুলির টানের বিচ্ছুরণ ও অক্লান্ত প্রোলেতারিয়েতের লার্জার দ্যান লাইফ-সংস্করণের এমন যুগলবন্দি সোনার হাতের ফুচকাওলা ছাড়া বড় একটা চোখে পড়ে না। |
|
|
|
|
|