মনে রাখার দিন
প্রায় চারশো বছর আগের কথা। ১৬২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে প্লিম’থ থেকে মেফ্লাওয়ার নামক একটি ছোট জাহাজে চেপে অ্যাটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলেন ওঁরা। সংখ্যায় ছিলেন ১০২। ইতিহাসে ওঁদের নাম হয়েছে ‘পিলগ্রিম’, তীর্থযাত্রী। আসলে ওঁরা ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’-এর আওতায় না থেকে নিজেদের মতো খ্রিস্টধর্ম পালন করতে চাইছিলেন, তাই পালতোলা জাহাজে চড়লেন এক দিন। লক্ষ্য: ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’, মানে আমেরিকা। সেখানে নিজের অভিরুচি অনুসারে ধর্মাচরণ করা যায়, কারও রক্তচক্ষু ভস্ম করে দিতে চায় না, তদুপরি সে দেশে অফুরন্ত জমি, সে জমিতে সোনা ফলে।
নতুন দেশে প্রথম শীতে প্রায় অর্ধেক মানুষ উজাড় হয়ে গেলেন। তার পর মধুর বসন্ত এল। এবং এলেন এক আদিবাসী মানুষ, ইংরেজি জানেন। আলাপ করলেন অতিথিদের সঙ্গে। দু’দিন পরে ফিরে এলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন আর এক আদিবাসী মানুষকে, তাঁর নাম স্কোয়ান্তো। তিনি নবাগতদের শেখালেন, কী কী ফসল ওখানে ভাল হয়, কী ভাবে সে সবের, বিশেষ করে ভুট্টার চাষ করতে হয়, কী ভাবে সংগ্রহ করা যায় মেপল গাছের রস, নদীর কোথায় ভাল মাছ পাওয়া যায়, চিনিয়ে দিলেন বিষাক্ত লতাপাতা। তিনিই ওঁদের আলাপ করিয়ে দিলেন স্থানীয় ওয়াম্পানোয়াগ জনজাতির অধিবাসীদের সঙ্গে, যে বন্ধুত্ব এর পর অন্তত পঞ্চাশ বছর স্থায়ী হবে।
কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রান এল। অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বর। ফসল উঠল। খুব ভাল ফসল হয়েছিল সে বার। সাহেবদের দলপতি, উইলিয়ম ব্র্যাডফোর্ড এক ভোজের আয়োজন করলেন। সেই ভোজসভায় ডাক পেলেন বন্ধু আদিবাসীরাও। তিন দিন ধরে চলল খাওয়াদাওয়া, নাচগান, হইচই। পরের বছর অজন্মা, খুব কষ্ট হয়েছিল সে বার, তাই ১৬২৩ সালে যখন আবার ভাল ফসল হল, গভর্নর ব্র্যাডফোর্ড বললেন, সবাই যেন শুদ্ধচিত্তে উপবাস করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়। তার পর, উপবাস ভাঙতে বড় ভোজ।
আস্তে আস্তে এই প্রথা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নভেম্বর মাসে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দিনে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য ভোজের আয়োজন, সঙ্গে গল্প, গান, নাচ, প্রার্থনা। শতাব্দী অতিক্রান্ত হল, ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হল, ১৭৮৯ সালের ৩ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন দেশবাসীকে আহ্বান জানালেন আমরা স্বাধীনতার সংগ্রামে সফল হয়েছি, নিজস্ব সংবিধান রচনা করেছি, আসুন, আগামী ২০ নভেম্বর সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে আমাদের সৌভাগ্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। সেই প্রথম সরকারি স্বীকৃতি। আরও অনেক যুগ পরে ১৯৪১ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ঘোষণা করলেন, প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার দিনটি আমেরিকায় ‘থ্যাংকসগিভিং ডে’ হিসেবে পালিত হবে। সেই ঐতিহ্য সমানে চলেছে।
পূর্ব উপকূলে ১৬২০’র ওই ভোজসভা থেকেই কি তবে থ্যাংকসগিভিং ডে শুরু হয়েছিল? তেমনটাই সচরাচর ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন আছে। দু’রকম প্রশ্ন। এক, তার আগেও আমেরিকার ইয়োরোপীয় অভিবাসীদের মধ্যে ফসল তোলার সময়ে এমন ভোজের আয়োজন হয়েছে। বস্তুত, দুনিয়ার সর্বত্রই নতুন ফসলের মরসুমে নানান উৎসব হয়, আর মানুষের উৎসবে ঈশ্বরের ডাক পড়বে, ফসলের জন্য ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানানো হবে, সে আর বিচিত্র কী? আমাদের ‘নবান্ন’র কথা ভুলি কেমনে? তবু, ভিনদেশি অতিথিদের সঙ্গে আদিবাসী মানুষের সখ্যের এমন গল্প, ভাবতে বেশ লাগে। ভেবে নিতেই পারি, সেই আদিপর্বে মহাসমুদ্র পার হয়ে আসা মানুষগুলো কেবল ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেননি, আমেরিকার ওই আদিবাসী মানুষগুলির হাত ধরে বলেছিলেন, ‘থ্যাংক ইউ’।
আর সেখানেই দু’নম্বর প্রশ্ন। ইতিহাস সাক্ষী আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের প্রতি আমেরিকায় স্থানীয় মানুষকে প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েই ইয়োরোপের আগন্তুকরা নতুন মহাদেশ দখল করেছিলেন, সে বড় নির্মম ইতিহাস। সেই ভয়ানক অতীতকে একটুখানি আড়াল করার তাগিদেই কি চারশো বছর আগের একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা বা নিছক রটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে একটা বন্ধুত্বের ইতিহাস হিসেবে চালানোর চেষ্টা? এ সংশয় অনেকেরই। তাঁরা অনেকেই ফি বছর থ্যাংকসগিভিং ডে’তে প্লিম’থ, ম্যাসাচুসেটস-এর সেই উৎসভূমিতে জমায়েত হন।
কালক্রমে উৎসব তার স্বভাবচরিত্র বদলেছে। যেমন বদলায়। দুর্গাপুজো থেকে শারদোৎসব, সে কি কম বদল? এখন আমেরিকায় এবং কানাডায় (সে দেশে অবশ্য অক্টোবরের দ্বিতীয় সোমবার), এবং দুনিয়ার আরও কোথাও কোথাও এই দিনটা আসলে পরিবারের দিন। মার্কিন দুনিয়ায় এটাই সম্ভবত এক নম্বর পারিবারিক উৎসব। বাড়িতে রান্না করে খাওয়া এবং খাওয়ানোর উৎসব, যে রান্নার মধ্যে টার্কি নামক পাখিটির মাংসের রোস্ট না থাকলেই নয়, তৎসহ রকমারি কেক আর পাই, আহা! এবং, হ্যাঁ, অবশ্যই, এ উৎসব বাজারের উৎসব। থ্যাংকসগিভিং ডে’র পরের দিনটি মার্কিন দুনিয়ায় কেনাকাটার ডি-ডে। কার্যত এই দিনটি দিয়েই শুরু হয়ে যায় বছর শেষের উৎসবের মরসুম। তবু পারিবারিকতাটুকু পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সবাইকে নিয়ে আনন্দ করেন ওঁরা। এবং মনে করেন গরিব, নির্বান্ধব মানুষগুলোর কথা, যাঁদের আপন গৃহ নেই, কাছের মানুষ নেই, এটি তাঁদের কাছে যাওয়ার দিন, খাবারদাবার নিয়ে, কিছুক্ষণের সাহচর্য নিয়ে। আনুষ্ঠানিক? হবেও বা, কিন্তু এই পারমাণবিক ভুবনে এমন অনুষ্ঠান যতটুকু থাকে, ভাল।
তবে সবচেয়ে ভাল অনুষ্ঠানের নামখানি। ওই ‘থ্যাংকস’ শব্দটি। অহরহ উচ্চারণ করি, খেয়াল রাখি না কোথা থেকে এল সে। আসলে ‘থ্যাংক’ এবং ‘থিংক’ এসেছে একই উৎস থেকে। যখন ‘থ্যাংক ইউ’ বলি, তখন আসলে বলি ‘আই থিংক (কিংবা, আই অ্যাম থিংকিং) অব ইউ’, তোমার কথা ভাবছি, তোমাকে মনে রাখছি। বাংলা ‘ধন্যবাদ’ বরং তুলনায় অনেক বেশি পোশাকি।
থ্যাংকসগিভিং ডে, অতএব, মনে রাখার দিন। কিছুমাত্র মন না দিয়ে, সম্পূর্ণ অভ্যাসবশে শূন্য-মনে ‘থ্যাংকস’ বলার যে অভ্যাস মজ্জাগত হয়ে গেছে, সেটা নিদেনপক্ষে বছরের একটা দিনে দূর করতে পারলে মন্দ হয় না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.