|
|
|
|
পটুয়াজীবনে নতুন রঙ পিংলার নয়ায় |
কিংশুক আইচ • মেদিনীপুর |
কোট-প্যান্ট পরা এক আমেরিকান সাহেব মন দিয়ে দেখছিলেন। পটুয়া স্বামী-স্ত্রী সাহেব দেখে বলেই ফেললেন, “স্যার এই পটগুলো দেখুন--সুনামি, ৯/১১ আর এইটা মাওবাদীদের নিয়ে।” সাহেব তেমন গা করলেন না। বরং পরিষ্কার বাংলাতেই বললেন, বীভৎস ঘটনা নিয়ে পট আঁকেন কেন? তার চেয়ে মাছের বিয়ের পট-টাই তো ভাল।
একটু আগেই এই সাহেব, মানে কলকাতায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল ক্লিন্টন ব্রাউন আনুষ্ঠানিক ভাবে পিংলার পটচিত্র মেলা ‘পটমায়া’র উদ্বোধন করেছেন। কলকাতা থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে পিংলার এই নয়া গ্রামের পটমেলার এটা দ্বিতীয় বছর। ব্রাউন বলেন, “আমি বাংলা শিখছি। বাংলার অন্যতম লোকশিল্প পট কেমন করে আঁকা হয়, তা নিজের চোখে দেখতে এসেছি।” শুক্রবার উদ্বোধনের পর দীর্ঘ ক্ষণ ধরেই মেলায় ঘুরলেন সাহেব।
জবা চিত্রকরের মাছের বিয়ের গান মন দিয়ে শুনলেন। বাহাদুর আর নাজু চিত্রকর দম্পতির সুনামি বা ৯/১১ সংক্রান্ত পটের দিকে তেমন নজর না দিলেও মাওবাদী-সমস্যা নিয়ে তাঁদের আঁকা পট অবশ্য খুঁটিয়েই দেখলেন। গুলির লড়াই, মাইন বিস্ফোরণ, গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ— এ সবই বিষয় হয়ে উঠেছে পটচিত্রে। শুধু পট নয়, পট-আঁকা টি-শার্ট, ল্যাম্প-শেড— এ রকম নানা জিনিসও রয়েছে মেলায়। ঘুরছেন প্রখ্যাত তবলাবাদক পণ্ডিত তন্ময় বসু, অভিনেত্রী সুদীপা বসু থেকে লন্ডনের গবেষক জেন রোয়ান বা জাপান থেকে আসা ইউনেস্কোর প্রতিনিধি মোয়েচিকা। ওঁরা সবাই উচ্ছ্বসিত মেলা দেখে। এ বার আবার বিহারের মধুবনি থেকে মেলায় এসেছেন মধুবনি চিত্রকররাও। তাঁদের এক জন চতুরারন ঝা বলেন, “এখানে না এলে পট কী, তা জানতাম না। খুব ভাল লাগছে।” দু’ধরনের রীতির শিল্পীরা মত বিনিময়ও করবেন। |
|
নিজস্ব চিত্র |
আগের বছরই কলকাতার এক সংস্থার উদ্যোগে নয়া-য় শুরু হয়েছে এই পটমেলা। এ বার গ্রামের ৬৫ জন পটুয়া বাড়ির আঙিনাতেই পট নিয়ে বসেছেন। কেউ পট আঁকছেন, কেউ ব্যস্ত কেনাবেচায়। পটের গানও চলছে সমানে। কলকাতার সেই সংস্থার পক্ষে অমিতাভ ভট্টাচার্য জানালেন, পট-শিল্পীরা মেলায় নিজেরাই নিজেদের শিল্পদ্রব্য বিক্রি করতে পারছেন। এতে তাঁদের আর্থিক লাভও বেশি। মেলা ঘিরে পটশিল্প নিয়ে শহরের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
কলকাতার কর্মকর্তার দাবি যে বানানো নয়, নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন ইয়াকুব চিত্রকর। ’৯৮ সালের কথা। গুটোনো পট নিয়ে গ্রামে ঘুরে দিনে যা আয় করতেন, তাতে সংসার চলত না। এক পরিচিতের কাছ থেকে ট্রলি কেনেন। ঠিক করেন ট্রলি চালিয়েই সংসার চালাবেন। কিন্তু এক দিন এক চিত্র পরিচালকের সঙ্গে আলাপ জীবন বদলে দেয়। পটের চেনা জগতে ফিরে পান নিজেকে। গত বছর ইংল্যান্ডের লিভারপুলেও প্রদর্শনী করে এসেছেন। এখন ইয়াকুব চান তাঁর ছেলেও পটুয়াই হোক। অন্য অনেক লোকশিল্পে যেখানে নতুন প্রজন্মের তেমন উৎসাহই নেই, সেখানে অন্য চিত্র পোটোপাড়ায়। বিশ্ব জুড়েই যে কদর রয়েছে তাঁদের পটের, বুঝেছেন ইয়াকুবরা। তাঁদের এই উপলব্ধির পথ খুলে দিচ্ছে কলকাতার সংস্থাটি, নয়া-র এই বার্ষিক মেলা। গত বছরই মেলায় ৭ লাখ টাকার কেনাবেচা হয়েছে।
কয়েক বছর আগেও যেখানে নয়া’য় আলো ছিল না, বালাই ছিল না শৌচাগারের, গ্রামের মানুষের গড় আয় ছিল মাসে দু’ থেকে তিন হাজার টাকা--এখন সেখানে পটুয়াদের বাড়িতে আলো জ্বলে। কাঁচা রাস্তায় মোরাম পড়েছে। স্বর্ণ, জবা, ইয়াকুব, আনোয়ার, বাহাদুর চিত্রকরদের মাসে গড় আয় আট থেকে পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে। পট আঁকা যে অর্থকরী এবং একই সঙ্গে সম্মানের, এই ধারণা গড়ে উঠছে। এই ‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে ময়না চিত্রকর তাই বলতে পারেন, “ছেলেমেয়েদের পট আঁকা শেখানোর পাশাপাশি এখন লেখাপড়াও শেখাচ্ছি। বিদেশে গিয়েও যাতে হোঁচট না খায়, সে জন্য ইংরাজিও শেখাচ্ছি।” ময়নারা পটকে আরও আঁকড়ে ধরতেই চাইছেন। নয়ার মেলা পরিণত ময়নাদের প্রাণের উৎসবে। |
|
|
|
|
|