কাকার সঙ্গে নামমাত্র দেখা হয়েছিল কবে কোন ছোটবেলায়। সেই কাকার দেহ শনাক্ত করার জন্যই অন্ধ্রপ্রদেশের অখ্যাত মফস্সল শহর থেকে প্রথম বার কলকাতায় এলেন মধ্য তিরিশের তরুণী।
কাকার নাম মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি। ভাইঝি দীপিকা মুত্তেআলা। হায়দরবাদ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে পেড্ডাপল্লি শহরের এক গৃহবধূ। দীপিকা ওরফে দীপার জন্মের আগেই কিষেণজি তাঁর বাড়ির থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হয়ে রাজনীতির জগতে ঢুকে পড়েছেন। তবু কাকাকে চিনতে তাঁর এতটুকু অসুবিধা হবে না বলেই মনে করছেন দীপা।
শুক্রবার বিকেলে বৌবাজারে কিষেণজিকে ভুয়ো সংঘর্ষে খুনের অভিযোগ তুলে একটি সভায় গিয়েছিলেন তিনি। সভার শেষে আটপৌরে শাড়ির মহিলা বলছিলেন, “কাকার গল্প শুনতে শুনতেই তো বড় হয়েছি। ঠাকুমা এখনও সব সময়ে কাকার কথা বলেন।” টিভি ক্যামেরার সামনে জড়োসড়ো। সংবাদমাধ্যমের সামনে কাকার মৃত্যুর ‘সুবিচার’ চাওয়ার সময় তেলুগু ও ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে কিছুটা আড়ষ্ট। কিন্তু ‘কিষেণজি লাল সেলাম’ বলে স্লোগান দেওয়ার সময়? সপ্রতিভ ভঙ্গিতে গলা মেলালেন দীপা।
পুলিশের চোখে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হলেও পরিবারের কাছে কিষেণজির অন্য ভাবমূর্তি। হিন্দিতে একেবারেই অপটু, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে দীপা বলেন, “ছোট থেকেই তো শুনে আসছি, কাকা গরিব মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়েছেন। আদিবাসীদের সেবায় ঘর ছেড়েছেন। জঙ্গলে থেকে দেশের সেবা করছেন। কাকার কথা এত শুনেছি, তাঁকে সব সময়েই খুব কাছের মানুষ বলে মনে হয়।” শেষ কবে দেখেছেন কাকাকে? দীপার জবাব, “সেটা সম্ভবত ১৯৭৯। তখন আমি চার বছরের শিশু। কাকা তার আগেই ঘর-ছাড়া। তখন কালেভদ্রেআসতেন।” এর পরের তিন দশকে কাকার সঙ্গে দেখা হওয়া দূরে থাক, তাঁর সঙ্গে ফোনে বা কোনও চিঠির মাধ্যমেও কথা হয়েছে বলে মনে করতে পারেন না তিনি। |
তবু কাকাকে শনাক্ত করার জন্য দীপাকেই এত দূর আসতে হয়েছে। তিনি বললেন, “আর কে আসত? ঠাকুমার ৮৪ বছর বয়স। ক্যানসারের রোগী। আমার বাবাও অসুস্থ। একটা কিডনি নেই ওঁর।” কিষেণজির আর এক ভাই, দীপার ছোট কাকা বেণুগোপালও সিপিআই (মাওবাদী)-র পলিটব্যুরো সদস্য। ঠাকুমা দীপাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কাকাকে কেমন দেখতে। দীপার কথায়, “ঠাকুমা বলে দিয়েছেন, কাকাকে একেবারে ঠাকুরদার মতো দেখতে ছিল। কাকাকে চিনতে তাই অসুবিধে হবে না। আমার ঠাকুরদা স্বাধীনতা-সংগ্রামী। নিজামের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন।”
নিয়ম অনুযায়ী, রক্তের সম্পর্কের কোনও আত্মীয় শনাক্ত করলে তবেই কিষেণজির দেহের ময়না তদন্ত করানো যাবে। সে দিক দিয়ে দীপার শনাক্তকরণটা প্রশাসনের জন্যও জরুরি। আবার কিষেণজিকে ‘খুন’ করার অভিযোগ তুলে যাঁরা তদন্তের দাবি করছেন, তাঁরাও চান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিধি মেনে যথাযথ ভাবে কিষেণজির দেহের ময়না তদন্ত করানো হোক।
মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ কবি ভারভারা রাও এবং অন্ধ্রপ্রদেশের দু’জন মানবাধিকার কর্মী চন্দ্রশেখর ও পদ্মা কুমারীর সঙ্গে বিমানে হায়দরাবাদ থেকে কলকাতায় নামার পরে দীপা এ দিন বিশ্রামের সুযোগ পাননি। বৌবাজারে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি’-র সভা থেকে মহাকরণে গিয়ে স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন। দীপা ও ভারভারা চেয়েছিলেন, কিষেণজির দেহ কলকাতায় নিয়ে এসে ময়নাতদন্ত করাক প্রশাসন। রাজ্য সরকার তাতে রাজি না হওয়ায় কালক্ষেপ না করে এ দিন সন্ধ্যাতেই কলকাতা থেকে মেদিনীপুরে রওনা হন দীপা, ভারভারা ও তাঁদের সঙ্গীরা। |