গাছের গায়ে একটা ‘হলুদ চৌখুপ্পি’। মাঝে একটা মোটা শালগাছ। গোড়ায় রক্তের দাগ। গাছের গা বরাবর উইয়ের ঢিপি।
বৃহস্পতিবার রাতে কিষেণজির গুলিবিদ্ধ দেহ যেখানে মিলেছে, গাছে-গাছে বাঁধা দু’ইঞ্চি হলুদ ফিতের বেড়ায় তৈরি ‘খোপ’টা সেখানেই। মাপ প্রায় ১০ ফুট বাই ১০ ফুট। দূরত্ব, জঙ্গলের প্রান্ত থেকে বড়জোর ৬০০ গজ। আশপাশে পাঁচ-ছ’টা গাছ অন্তর এক জন করে সিআরপি জওয়ান। জলপাই পোশাক। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। শরীরী-ভাষায় পরিষ্কার, প্রয়োজনে গুলি চালাতে বড়জোর কয়েক সেকেন্ড লাগবে।
বারুদের গন্ধ নেই। কিন্তু শুক্রবারের বুড়িশোল এমনই আষ্টেপৃষ্ঠে ঘেরা ছিল সতর্ক চোখের নজরদারিতে, আগ্নেয়াস্ত্রের নিশানায়। |
ঝাড়গ্রাম শহর থেকে বুড়িশোল জঙ্গল মাত্র ১৫ কিলোমিটার। দহিজুড়ি পেরিয়ে কংসাবতী ক্যানাল পর্যন্ত পাকা রাস্তা। তার পরে বাঁ দিকের মাঠে মোরাম ফেলা পথে আরও দু’-তিন কিলোমিটার। এখানেই বন দফতরের গড়ে তোলা শাল-পিয়াল, আকাশমণির জঙ্গল বুড়িশোল।
হাল্কা শীত। পাতা ঝরা শুরু হয়েছে। জঙ্গলের শাল-পিয়ালের সারি অনেকটাই নেড়া। ভোর হতেই গাছের সারির ফাঁক দিয়ে তেরচা হয়ে রোদ ঢুকেছে। কুয়াশার পাতলা চাদর। প্রাকৃতিক উত্তাপ কম, কিন্তু সে উত্তাপের ঘাটতি সুদে-আসলে পুষিয়ে দিচ্ছে এলাকার ‘পরিস্থিতি’। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে মাওবাদীদের সংঘর্ষের
সময়ে বুড়িশোলের কিলোমিটার দু’য়েক আগেই আটকে দেওয়া হয়েছিল সাংবাদিকদের। এ দিন আর একটু এগনো গিয়েছে। জঙ্গলের প্রান্ত থেকে ওই ‘হলুদ চৌখুপ্পি’ পর্যন্ত।
তার পরেও জঙ্গলের অনেকটা জুড়ে যৌথ বাহিনীর ঘোরাফেরা। দূর থেকে ভাল ঠাহর করা যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে গাড়ি আসছিল, তাতে সিআরপি জওয়ানেরা। সারি দিয়ে জঙ্গলে ঢুকেই তারা কী যেন খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। পরে জানা গেল, বৃহস্পতিবারের লড়াইয়ে ব্যবহৃত কার্তুজের ফাঁকা খোল খুঁজছেন। পেয়েওছেন অজস্র খোল। আশপাশের অনেক গাছের ছাল-বাকলেও চোখে পড়েছে গুলির ক্ষত।
ঘণ্টা তিনেক কাটল। বেলা ১২টা নাগাদ পৌঁছলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। হনহনিয়ে হেঁটে এগোলেন ওই ‘হলুদ চৌখুপ্পি’র দিকে। তবে পুরোটা যাননি। দূর থেকে দেখেই ফিরলেন। কাটালেন বড়-জোর পাঁচ মিনিট। |
আবার সব চুপচাপ। জওয়ানদের জঙ্গলে ঢোকা আর বেরনো। ছবিটা বদলাল, যখন সিআরপি-র চার গাড়ির ‘কনভয়’ ঢুকল মোরাম রাস্তায়। নামল বিরাট বাহিনী। সঙ্গে প্রশিক্ষিত কুকুর। মাইন খোঁজার যন্ত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সিআরপি-র ডিজি কে বিজয় কুমার আসছেন ঘটনাস্থলে। তারই প্রস্তুতি। প্রস্তুতি-পর্ব চলতে চলতে বেলা ১টা পার। হঠাৎ দু’হাতে দু’টো ছেঁড়া মাদুর, কয়েকটি সিগারেটের প্যাকেট, এক জোড়া চটি আর কিছু কাগজ নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন এক জওয়ান। কার এগুলো? জওয়ানের দাবি, “এগুলো কিষেণজির কাছ থেকে মিলেছে।”
বিজয়কুমার ঢুকলেন প্রায় আড়াইটে। ঘটনাস্থলে দাঁড়ানো জওয়ানদের কয়েকজনের পিঠ চাপড়ে সোজা ‘হলুদ চৌখুপ্পি’র পাশে। হলুদ ফিতের পাশে দাঁড়িয়েই জওয়ানদের কাছে শুনলেন, কিষেণজি-পর্বে কী হয়েছিল। সংঘর্ষে প্রথম সারিতে থাকা পাঁচ জওয়ানকে কাছে ডাকলেন। তাঁদের সঙ্গে কিছু কথা। ফের পিঠ চাপড়ানি। এর পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে সিআরপি-র ডিজি ফিরে গেলেন জামবনি। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে দমদম হয়ে দিল্লি যাওয়ার কথা তাঁর।
বিকেল ৪টেয় ঘটনাস্থল ছাড়তে শুরু করলেন সাংবাদিকেরা। জওয়ানেরা ‘পজিশন’ নিচ্ছিলেন। কেউ কেউ দাঁড়ালেন ওই ‘হলুদ চৌখুপ্পি’র গা ঘেঁষে।
কিষেণজি শেষ। ‘অপারেশন’ নয়। |