|
|
|
|
সংঘর্ষ নিয়ে সংশয়ের মধ্যেই দিনভর চলল জোর তল্লাশি |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
কিষেণজি খতম হওয়ার পরেও বৃহস্পতিবার রাতভর এবং শুক্রবার সারাদিন বুড়িশোল জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলো কার্যত অবরুদ্ধ করে অভিযান চালাল যৌথ বাহিনী। কিন্তু কিষেণজির ছায়াসঙ্গী মাওবাদী নেত্রী সুচিত্রা মাহাতোর হদিস মিলল না।
কোথায় গেলেন সুচিত্রা? তাঁর এই উধাও হয়ে যাওয়াই সৃষ্টি করেছে ধোঁয়াশা। বৃহস্পতিবার থেকে পুলিশ বারবারই দাবি করেছে, কিষেণজির সঙ্গে ছিলেন সুচিত্রাও। তিনি জখমও হয়েছেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় একে-৪৭ রাইফেলটি তিনি ফেলে যান কিষেণজির দেহের পাশে। সেটি পরে উদ্ধার করে যৌথ বাহিনী। তা হলে পরের গোটা দিনেও তাঁর খোঁজ নেই কেন? অনেকেই মনে করেন, জখম অবস্থায় সুচিত্রার পক্ষে খুব বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়। যৌথ বাহিনীও তল্লাশি অভিযানে কোনও রকম ঢিলে দেয়নি। তা হলে? একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, কিষেণজিকে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকা দেহরক্ষীদেরই বা কী হল? কোথায় গেল তারা? তা ছাড়া, দু’পক্ষের সংঘর্ষে শুধু কিষেণজিই কেন নিহত হলেন? পুলিশের একটি অংশ বলছে, কিষেণজি ছাড়াও সংঘর্ষে আরও তিন জন মারা গিয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে বলা হয়েছে, কয়েক জনকে ধরাও হয়েছে। কিন্তু সরকারি সূত্রে এ কথা স্বীকার করা হয়নি। ফলে সংশয় আরও বেড়েছে।
কিষেণজির দেহ শনাক্ত করতে এসেছেন মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ কবি ভারভারা রাও। সঙ্গে কিষেণজির ভাইঝি দীপা। ভারভারাও এ দিন এই প্রশ্নগুলি তুলেছেন। কিষেণজির পরিবার সূত্রেও ‘ভুয়ো সংঘর্ষের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। এমনকী, সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্তও দাবি করেছেন, ঘটনার স্বাধীন তদন্ত করা হোক।
সিআরপিএফ এবং পুলিশ অবশ্য এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সিআরপিএফের ডিজি কে বিজয়কুমার বলেন, “পুলিশের হাতে মাওবাদীদের মৃত্যু হলেই গড়াপেটার অভিযোগ ওঠে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে জওয়ানেরা গুলির লড়াইয়ে নামেন তাঁদের কথা কেউ বলে না।” অন্য দিকে, রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ দাবি করেছেন, “সুচিত্রার খোঁজে তল্লাশি চলছে।” |
|
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন আলো ফোটার আগেই বেনাশোল, কপাটকাটা ও সরাকাটার মতো জঙ্গলঘেঁষা গ্রামগুলো ঘিরে ফেলে যৌথ বাহিনী। অভিযোগ, গ্রাম থেকে তো বটেই, ঘর থেকেও বেরোতে দেওয়া হয়নি কারওকে। সাংবাদিকদেরও গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয় যৌথ বাহিনী। একে একে সব বাড়িতে তল্লাশি করে পুলিশ। বিকেলের পরে অবশ্য গ্রামের ঢোকা-বেরোনোর সব রাস্তা খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওই সব গ্রামের সাধারণ মানুষ। অচেনা মুখ দেখলেই ঘরের ভিতরে চলে গিয়েছেন মহিলারা। গ্রামে বাইরের কেউ থাকত কি না, কাউকে চিনতেন কি না, এ সব প্রশ্নেরই উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন গ্রামের পুরুষরাও।
বৃহস্পতিবার রাতেই বুড়িশোলের জঙ্গল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল কিষেণজির দেহ। এ দিন বেলা আড়াইটে নাগাদ ঝাড়গ্রাম থেকে কাচে ঢাকা গাড়িতে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কিষেণজি-র দেহ পৌঁছয় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। মেডিক্যাল কলেজ চত্বরেও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ দিন অবশ্য দেহের ময়না-তদন্ত হয়নি। তবে কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি-র একাধিক বিশেষজ্ঞ বিকেলের দিকে মর্গে আসেন। সংঘর্ষ নিয়ে ওঠা বিতর্কের প্রেক্ষিতে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন।
কিষেণজির দেহটি শনাক্ত করতে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কিষেণজির ভাইঝি দীপাকে নিয়ে রাতেই মেদিনীপুরে পৌঁছেছেন মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ লেখক ভারাভারা রাও। পশ্চিম মেদিনীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, নিয়মানুযায়ী জামবনি থানায় (‘সংঘর্ষ’ যেখানে হয়েছিল বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই বুড়িশোল এই থানা এলাকায়) দেহ শনাক্ত করতে চেয়ে মৃতের নিকট জনেদের আবেদন করতে হবে। তার ভিত্তিতে জামবনির তদন্তকারী অফিসার আবেদনকারীদের নিয়ে দেহ শনাক্ত করতে আসবেন। তার পরেই ময়না-তদন্ত হবে। সে ক্ষেত্রে আজ, শনিবার ময়না-তদন্তের সম্ভাবনা রয়েছে। মহাকরণে রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, ময়নাতদন্তের পরে কিষেণজির পরিবারের লোকেরা চাইলে তাঁর দেহ নিয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর মৃতদেহ হায়দরাবাদে পৌঁছে দেওয়া হবে।
বুড়িশোল জঙ্গলও এ দিন ঘিরে রেখেছিল যৌথ বাহিনী। শুক্রবার সকালে থেকে মাইন-সন্ধানী যন্ত্র ও পুলিশ কুকুর নিয়ে এলাকার আনাচে-কানাচে তল্লাশি চালায় সিআরপি। বিকেল পর্যন্ত গোটা পঞ্চাশেক ফাঁকা কার্তুজই শুধু জোগাড় করে তারা। সিআরপি-র ১৬৭ ব্যাটেলিয়নের কম্যান্ডান্ট শ্যামচাঁদ দে জানান, সব গুলোই একে ৪৭ রাইফেলের কার্তুজ। দুপুর ১২টা নাগাদ রাজ্য পুলিশের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায় ওয়েস্টার্ন রেঞ্জের আইজি গঙ্গেশ্বর সিংহকে নিয়ে বুড়িশোলের জঙ্গলে আসেন। যেখানে কিষেণজির দেহ পড়েছিল, সেই এলাকাটি ঘুরে দেখেন তিনি। তার আগে জেলা পুলিশের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ডিজি অভিযানের পরবর্তী ধাপ নির্দিষ্ট করে দেন বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। এক পুলিশকর্তা বলেন, “কিষেণজির দু’টি মোবাইলের নম্বর বার করে ‘কল লিস্ট’ দেখা হচ্ছে। যে সিম কার্ডগুলো পাওয়া গিয়েছে তার দু’টি ওড়িশা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।” ওই পুলিশকর্তা জানান, উদ্ধার হওয়া কাগজপত্রের বিষয়বস্তু মূলত সংগঠন সংক্রান্ত। দলের নানা খরচের হিসেব-নিকেশ ও লেভি তোলার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কথাও লেখা রয়েছে তাতে।
রাজ্য পুলিশের ডিজি ঘুরে যাওয়ার পরে এ দিন ঘটনাস্থলে আসেন সিআরপি-র ডিজি কে বিজয়কুমার-ও। মাওবাদী দমনে তাঁর বিশেষ বাহিনী ‘কোবরা’র সাফল্যের খবর পেয়ে বৃহস্পতিবারই তিনি জঙ্গলমহলে আসার কথা জানিয়েছিলেন আইজি (অপারেশন) বিবেক সহায়কে। সেই মতো কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে করে এ দিন জামবনিতে আসেন বিজয়কুমার। সেখান থেকে সড়কপথে বুড়িশোলের জঙ্গলে পৌঁছে প্রথমেই তিনি কোবরা-র জওয়ানদের মুখ থেকে রাতের ‘অপারেশন’-এর বিবরণ শোনেন। পরে তিনি বলেন, “কিষেণজিকে খুঁজছিল গোটা দেশের পুলিশ। এত দিনে সাফল্য এল।”
এ দিন দুপুরেই বুড়িশোলে পৌঁছয় সিআইডি-র একটি দল। আসেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা রক্তমাখা মাটি ও রাইফেলের বেশ কিছু ফাঁকা কার্তুজ সংগ্রহ করেন। রাজ্যের এক পুলিশকর্তা বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশ মেনে জামবনি থানায় একটি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে। যৌথ বাহিনী কোন পরিস্থিতিতে কিষেণজিকে লক্ষ করে গুলি করেছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। সিআইডি ওই তদন্ত করবে।” পুলিশ সূত্রের খবর, বাহিনীর সাফল্যের জন্য এ দিনই সিআরপি-র ডিজি ১২ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে সাত লক্ষ টাকা দিয়েছেন তিনি নিজের বাহিনীকে, পাঁচ লক্ষ টাকা পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশকে। রাজ্যের এক পুলিশকর্তা বলেন, অন্ধ্রপ্রদেশে কিষেণজির মাথার দাম ২০ লক্ষ টাকা, ছত্তীসগঢ়ে সাত লক্ষ। ওই টাকাও পাবে এই রাজ্যের যৌথ বাহিনী। |
|
|
|
|
|