ওই হাতের পাঞ্জার চাপ ভোলার নয়
মুখোমুখি হয়েছি তিন বার। কিন্তু প্রাণভয় হয়েছিল সেই একবারই। যখন সফর-সঙ্গী কিছু আলোকচিত্রীকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, “ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!”
অ্যারেস্ট?
ভয়ে তো লোম খাড়া হওয়ার জোগাড়! জঙ্গল থেকে আর বোধহয় বেরোনো হল না। মাওবাদী শীর্ষনেতার মুখের ছবি তোলার ‘শাস্তি’ কী হতে পারে, তখন সেটাই ভেবেই চলেছি। পরে অবশ্য ক্ষমা চাওয়ায় এবং ক্যামেরা থেকে ছবি মুছে দেওয়ায় রাগ পড়ল। যেন কিছুই হয়নি, এ ভাবে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি।
তিনি কিষেণজি। সাড়ে পাঁচ ফুটের সেই চেহারাটাকে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে যখন বুড়িশোলের জঙ্গলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলাম, প্রথমে ঠিক বিশ্বাস হয়নি। কাছ থেকে গিয়ে দেখে বুঝলাম, চোখের ভুল নয়। গুলিতে ক্ষতবিক্ষত যে লাশটা জমিতে বাঁ দিকে কাত হয়ে লুটিয়ে আছে, সেটা সিপিআই (মাওবাদী)-র তিন নম্বর ব্যক্তিটিরই। আর যাই হোক ওই হাতের পাঞ্জাটা ভুল হওয়ার নয়। সেই পাঞ্জার চাপ যে তিন তিন বার অনুভব করেছি নিজের ডান হাতে।
তিন বার একেবারে সামনে থেকে দেখেছি। প্রতিবারই পরনে এক পোশাক। কিছু স্মৃতি আজ না চাইতেও ঘুরেফিরে আসছে মাথায়। ২০০৯-এর ১৮ জুনের আগে পর্যন্ত শুধুই নাম শুনেছি। ২০০৪ সাল থেকে জঙ্গলমহলে মাওবাদী সংগঠনের ভার ছিল তাঁরই কাঁধে। ঝাড়গ্রামে থেকে কাজ করার সুবাদে কিষেণজির নাম পুলিশমহলের কাছে বারবার শুনেছি। জানতাম ভাল নাম মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও। অন্ধ্রের লোক। মাওবাদীদের পলিটব্যুরো সদস্য। ২০০৭ সাল থেকে লালগড়ে আন্দোলন গড়ে তোলার পিছনে তিনি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ে বিস্ফোরণের পরিকল্পনা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলে পুলিশের দাবি। তার পর থেকে লালগড়ে যে অবরোধ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার রাশ ছিল তাঁরই হাতে। তখনও পর্যন্ত কিষেণজি বলতে আমার কাছে ভাসা ভাসা, টুকরো টুকরো এই সব তথ্য। আর তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা কিছু ‘মিথ’। তাঁকে নাকি চোখে দেখা যায় না! এই আছেন বেলপাহাড়ির জঙ্গলে, তো খানিক পরেই তাঁকে নাকি দেখা যায় লালগড়ের জঙ্গলঘেরা গ্রামে। দু’হাতে বন্দুক চালানোয় সমান দক্ষ। অক্লেশে হাঁটতে পারেন মাইলের পর মাইল জঙ্গল-পাহাড়ি পথ।
সেই লোকই মুখোমুখি দেখা দেবেন, এটা যে দিন কানে এল, উত্তেজনা আর অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছিল। জনগণের কমিটির আন্দোলনে অবরুদ্ধ জঙ্গলমহলকে ‘মুক্ত’ করতে যৌথ বাহিনী তখন লালগড়ের দোরগোড়ায়। ২০০৯ সালের ১৮ জুনের দুপুর।
বড়পেলিয়া চকে পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটির সদর দফতরে
সাংবাদিক-আলোকচিত্রীদের ভিড়। জানা গেল, স্বয়ং কিষেণজি নির্বাচিত কয়েক জন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন। সেজন্য হাঁটা পায়ে যেতে হবে অনেকটা জঙ্গলপথ। কয়েক জন যুবক মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে আমাদের পিচ রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা পথ নিয়ে গেল। তার পর পিচরাস্তা ছেড়ে ‘গাইড’কে অনুসরণ করে হেঁটে জঙ্গলের পথে এঁকেবেঁকে বেশ কিছুটা যাওয়ার পর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনো গেল।
পরে বুঝেছিলাম, তাঁর অবস্থান গুলিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের একই জঙ্গলপথে বার বার ঘোরানো হয়েছিল সে দিন। জঙ্গলের মাঝে একটু পাতলা হয়ে আসা ঝোপ। সেখানেই প্রথম দেখা। খেজুর গাছের ডালে সাদা কাপড়ে লালকালিতে লেখা মাওবাদী-ব্যানার ঝুলছে। আশেপাশে আগ্নেয়াস্ত্র কাঁধে মাওবাদী স্কোয়াডের কয়েক জন সদস্য কড়া পাহারায়। অভ্যর্থনার পরে আকাশি স্ট্রাইপ শার্ট আর নস্যি রঙের ট্রাউজার পরা যিনি নিজেকে কিষেণজি বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর হাতে বা কাঁধে সেদিন আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না।
আজ বলতে দ্বিধা নেই, চেহারা দেখে অবাকই হয়েছিলাম। আসলে কোনও দিন না দেখা অবয়বটা সম্পর্কে নিজের অজান্তেই মন একটা বড়সড় কাউকে কল্পনা করে নিয়েছিল। তবে করমর্দনের সময় তাঁর হাতের পাঞ্জার জোর টের পেয়েছিলাম। মাথায় জলপাই-বেগুনি জংলা টুপি। মুখটা কিছুটা আড়াল করার জন্য মাথা থেকে কাঁধ পর্যন্ত নীল-সাদা চেক গামছা। ডেরায় পৌঁছতেই জল খেতে দেওয়া হয়েছিল স্টিলের গ্লাসে।
দক্ষিণ ভারতীয় টানে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার-পর্ব শেষ হওয়ার পর, কিষেণজি সে দিন জানতে চেয়েছিলেন, কী ভাবে কোথা থেকে খবর পাঠাব। কত দিন সাংবাদিকতা করছি। সঙ্গী আলোকচিত্রী দেবরাজ ঘোষের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কোথায় বাড়ি। প্রশংসা করেছিলেন তাঁর তোলা কিছু ছবির। গামছায় মুখ ঢাকা পিছন দিক থেকে তোলা ছবিতে তাঁকে কেমন দেখাচ্ছে, তা-ও দেবরাজের ক্যামেরায় ‘চেক’ করে নিয়েছিলেন। ফেরার সময় চা না খাওয়াতে পারার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেছিলেন। কানে যে তিনি একটু কম শোনেন, সে-ও বুঝেছিলাম প্রথম সাক্ষাতেই। আস্তে প্রশ্ন করলে, দু’বার জিজ্ঞাসা করতেন।
এর পর থেকেই অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতোই মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়া বা ‘কোট’ নেওয়ার জন্য বহু বার কিষেণজির সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা হয়েছে। এবং কথার ফাঁকে একবার না একবার ‘জেনেগেণ’ (জনগণ) শব্দটা থাকতই। একটা সময় কার্যত তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে মাওবাদীদের ‘মুখ’ হয়ে উঠেছিলেন। সংবাদপত্র থেকে বৈদ্যুতিন মাধ্যম, তখন চাইলেই কথা বলতে পারছে কিষেণজির সঙ্গে। লালগড় তখন বস্তুত মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। মাঝে মধ্যেই ফোন রাখার সময় ‘আপনার জীবনসঙ্গিনীকেও শুভেচ্ছা জানাবেন’ কিংবা পরিজনেরা কেমন আছেন, জানতে চাইতেন এই শীর্ষ মাওবাদী নেতা। খবরে সিপিআই (মাওবাদী)-র সমালোচনা থাকলে তর্কও করতেন।
রাগ দেখেছিলাম একবারই। ২০০৯-এর ২২ অক্টোবর। সাঁকরাইল থানার অপহৃত ওসি অতীন্দ্রনাথ দত্তকে মুক্তি দেওয়ার রাত। লালগড়ের ভুলাগাড়া গ্রামে তখন দেশের তাবড় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে সাঁকরাইলের প্রাক্তন ওসি-কে মুক্তি দিলেন কিষেণজি। ফেরার সময় এক মহিলা সাংবাদিককে ঠাট্টা করেই বলেছিলেন, “আপনার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়তো হবে না। যদি সম্ভব হয় রান্না করা খাবার আর মিষ্টি পাঠাবেন।” ওই দিনই সাক্ষাৎকার শুরুর আগে ইনসাস কাঁধে কিষেণজির উগ্রমূর্তি দেখেছিল সংবাদমাধ্যম। তাঁর মুখের ছবি তোলা যে নিষেধ, তা জানতেন না কয়েক জন আলোকচিত্রী। মাওবাদী পলিটব্যুরো সদস্যকে হাতের নাগালে পেয়ে ফটাফট সামনে থেকে ছবি তুলে নিয়েছিলেন তাঁরা। তাতেই বিপত্তি। ওই আলোকচিত্রীদের সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে কিষেণজি বলেছিলেন, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট’। পরে আলোকচিত্রীরা ভুল স্বীকার এবং ছবি ‘ডিলিট’ করার পরেই সব স্বাভাবিক।
ব্যারাকে ফিরে স্ত্রীকে
ফোন। নিজস্ব চিত্র
কিষেণজি কত দ্রুত এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারেন, তার প্রমাণ পেয়েছিলাম ওই বছরই ১৯ অগস্ট। সেই বিকেলে লালগড়ের আজনাশুলি গ্রামের লাগোয়া জঙ্গলে সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ঝেঁপে বৃষ্টি। এক ছুটে একটা মাটির বাড়িতে সবাইকে নিয়ে ঢুকে গেলেন কিষেণজি। গামছা দিয়ে মুছলেন কাঁধে থাকা ইনসাসের গায়ে লাগা বৃষ্টির জল। বৃষ্টি থামতে ফের জঙ্গলে মুখোমুখি কিষেণজি আর আমরা। হঠাৎ শোনা গেল, যৌথ বাহিনী খুব কাছে চলে এসেছে। জনা আটেক কমবয়সী সশস্ত্র দেহরক্ষীদের নিয়ে নিমেষে কিষেণজি উধাও! এত অল্প সময়ের মধ্যে হেঁটে পঞ্চাশোর্ধ্ব একটা মানুষ কী ভাবে পালাতে পারেন, চাক্ষুষ করেছিলাম সেদিন। আমাদেরও নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গেলেন বাকি স্কোয়াড সদস্যেরা।
যৌথ বাহিনী অবশ্য আসেনি। সন্ধ্যায় বাকি সাংবাদিকেরা চলে যাওয়ার পরে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন কিষেণজি। সহকর্মী সুনন্দ ঘোষ, দেবরাজ আর আমাকে সে দিন এক রকম জোর করেই লুচি আর কষা-মুরগি খাইয়েছিলেন ওই মাওবাদী নেতা। আমাদের সঙ্গেই জঙ্গলের মাঝে খাটিয়ায় বসে নিজেও তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন। ইনসাসটা রাখা ছিল খাটিয়ায়। থালা রাখতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে বললেন, “হাতিয়ারটার জন্য থালা রাখতে পারছেন না। দাঁড়ান সরিয়ে নিচ্ছি।” বলে খাটিয়ার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখলেন ইনসাস।
সাক্ষাৎকারের ফাঁকে জানতে চেয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমকে পাঠানো তাঁর লেখা বাংলা কবিতাগুলি কেমন হয়েছে। খুনের রাজনীতির যৌক্তিকতা বা তাঁদের প্রত্যাশিত ‘বিপ্লবী জনগণের দেশ’ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে কিষেণজি স্বভাবসিদ্ধ পাঞ্জার জোরে ঝাঁকিয়ে করমর্দন করে বলেছিলেন, “জনগণ না চাইলে হটে যাব।”
ফেরার আগে তিন জনের সঙ্গেই করমর্দন করেছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে বুড়িশোলের জঙ্গলে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহটাকেও প্রথমে চিনেছিলাম সেই অদ্ভুত বড় রকমের হাতের পাঞ্জা দেখেই!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.