চার দিকে গিজগিজ করছে সিআরপি-র জওয়ান। পদস্থ কর্তাদের ভিড়ও কম নয়। তার মাঝে দাঁড়িয়ে ওই জওয়ান বলতে লাগলেন, “বিকেল তখন সওয়া ৪টে হবে। কংসাবতী খালের দিকে আমরা ছিলাম চার জন। অন্য দিকে আরও তিন জন। কনুইয়ে ভর দিয়ে হাঁটু গেড়ে বেশ খানিকটা এগোতেই দেখলাম, দু’টো লোক আর একটা মহিলা গাছের আড়ালে বসে আছে। তাদের তিন জনেরই কাঁধে একে-৪৭ রাইফেল। কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে তাদের সরাসরি নিশানা করা সম্ভব নয়। তাই আরও একটু এগোবো কি না ভাবছি, তখনই পায়ের চাপে শুকনো পাতা ভাঙার শব্দ হতেই গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ পরা মহিলাটি ট্রিগারে আঙুল চেপে ধরল।”
ওই মহিলাই নিহত মাওবাদী নেতা শশধর মাহাতোর স্ত্রী সুচিত্রা মাহাতো। তত ক্ষণে কোবরা-র পাশাপাশি রাজ্যের কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স (সিআইএফ)-ও যে আরও দু’দিক থেকে তাঁদের ঘিরে নিয়েছে তা বুঝতে পারেননি ওঁরা। ওই জওয়ান ডিজি-কে বলেন, “আমাদের লক্ষ করে গুলি চালাতে শুরু করে ওরা। ওদের গুলি চালাতে দেখে পাল্টা গুলি চালায় সিআইএফ-ও। এর ফাঁকে কনুইয়ে ভর দিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে একেবারে নিশানার নাগালে পেয়ে যাই এক জনকে।” পরে জানতে পারেন, সেই মানুষটিই কিষেণজি।
ডিজি-কে জওয়ান বলে চলেন, “আচমকাই একটা গুলি এসে লাগে আমার ডান হাতে। নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে
এ বার ওই হাত দিয়েই লাগাতার পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করি। একটা গুলি লোকটার পায়ে লাগতেই ও পড়ে যায়। এতটুকু সময় নষ্ট না করে ফের ট্রিগার চেপে ধরি। এ বার গুলি ওর চোয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়।”
পুলিশ জানাচ্ছে, ৪১টি কার্তুজের খোল পাওয়া গিয়েছে কিষেণজির মৃতদেহের আশপাশে। তার মানে, মৃত্যুর আগে কমপক্ষে ৪১ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিলেন ওই মাওবাদী শীর্ষ নেতা। তাতেও অবশ্য লড়াইয়ে পেরে ওঠেননি তিনি। কিষেণজির হাত থেকে রাইফেল পড়ে যেতেই গুলি চালানো থামিয়ে দেয় যৌথ বাহিনী। কোবরা-র জওয়ানেরা ডিজি-কে জানান, ওই গুলিবৃষ্টির ফাঁকেই নিজের রাইফেল ফেলে পালিয়ে যান সুচিত্রা, একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায়। শুক্রবার রাত পর্যন্ত তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কী ভাবে যৌথ বাহিনীর ঘেরাটোপ থেকে পালিয়ে গেলেন সুচিত্রা, তারই চুলচেরা হিসেব কষছেন পুলিশকর্তারা। |
বুড়িশোলের এই জঙ্গল অবশ্য সুচিত্রা মাহাতোরই খাস তালুক। দিন ছয়েক আগে বুড়িশোলে এসে পৌঁছেছিলেন কিষেণজি। ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলার রাইকা পাহাড় পেরিয়ে, দুয়ারসিনি, ঝাঁটিঝর্নার জঙ্গলপথ ধরে এ রাজ্যের শিমূলপাল, কুশবনি হয়ে বুড়িশোলে ঢোকেন তিনি। রাজ্যের গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত ১০ দিনে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছিল জঙ্গলমহলের।
পুরুলিয়ার বলরামপুরে যৌথ বাহিনীর হাতে দুই স্কোয়াড সদস্যের মৃত্যুর পরে অযোধ্যায় বেশ খানিকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে মাওবাদীরা। লালগড়, বেলপাহাড়ি, শালবনি ও বিনপুরে অভিযানের তীব্রতা বাড়ায় পুলিশ। সেই ভয়ে মদন-বিকাশ-জয়ন্ত, শ্যামলের স্কোয়াডগুলোও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের সাহস ও উৎসাহ দিতে এবং
সেই সঙ্গে ২-৮ ডিসেম্বর জঙ্গলমহলে ‘পিএলজিএ সপ্তাহ’ পালনে সংগঠনের পরিকল্পনা কী হবে, তা চূড়ান্ত করাও কিষেণজির আগমনের অন্যতম কারণ ছিল। |
পুলিশ জানাচ্ছে, এ রাজ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যৌথ বাহিনীর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন কিষেণজি। চার দিন আগে ঘাটশিলা লাগোয়া বেলপাহাড়ির শিমুলপাল জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে গুলির লড়াই হয় সিআইএফের। তাতে শ্যামলের স্কোয়াডের এক জনের মৃত্যু হয় বলে পুলিশের দাবি। সেখান থেকে তাড়া খেয়েই কুশবনির জঙ্গল দিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে বুড়িশোলে পৌঁছন কিষেণজি। সেখানে যে এমন ‘সাফল্য’ মিলবে, ভাবেননি সিআরপি-র ডিজিও। তাই এ দিনই তিনি ‘পুরস্কার’ মূল্য হিসাবে ১২ লক্ষ টাকা দিয়ে গেলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠীর হাতে। |