ব্যাগ গুছিয়ে... এ বার ‘পারি’র প্রেমে
ন্ডন শহরকে বিদায় জানিয়ে যে দিন বেরোলাম, পঞ্চমীর সকালের কলকাতার ছবি তখন মনে উঁকি দিচ্ছে। যাওয়ার পথের দু’ধারে প্রকৃতির আশ্চর্য সাজ। হলুদ-সবুজ-খয়েরির মিলমিশে গাছের পাতার সঙ্গে দিগন্তবিস্তৃত সবুজের সহাবস্থান। চার পাশে একটা নির্ভার আবহাওয়া। চার লেনের ঝকঝকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে বাস, ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার গতিতে। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রায় প্রথম থামা ফোকস্টোন স্টেশনে। ট্রেনে উঠতে হবে সেখান থেকে। বাস থেকে না নেমেই উঠে পড়া সেই ট্রেনে।
কখন যে চোখের নিমেষে, মাত্র ঘণ্টা দেড়েকে পার হয়ে গেলাম ইংলিশ চ্যানেল, বুঝতেই পারলাম না। কারণ, ওই রেল লাইনের বেশির ভাগই যে ইংলিশ চ্যানেলের তলা দিয়ে! তা পার হয়ে কিছুটা পথ বাসে গিয়ে পৌঁছনো প্যারিসে।
স্যেন নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই শহর আদ্যোপান্ত ইতিহাসে মোড়া। প্রথমে লা স্যেন-এ নৌকাবিহার। দু’তীর জুড়ে গথিক স্থাপত্যের নানা নিদর্শন। সঙ্গে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের আড্ডার টুকরো টুকরো ছবি। কথায় আছে, এই নদীর মধ্যে ফুটে ওঠে প্যারিস শহরের নিজস্ব এক প্রতিবিম্ব। ৭৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী প্যারিসের ‘লাইফলাইন’ বললেও অত্যুক্তি হয় না। আর যার কথা না বললে এই নৌকাবিহার অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তা হল আইফেল টাওয়ার। ডাকনাম ‘দি আয়রন লেডি’। ১৮৮৯-এ গুস্তভ আইফেলের সৃষ্ট, ৩২৪ মিটার উঁচু এই মিনার শহরের অন্যতম এক গ্লোবাল আইকন। প্যারিস শহরের সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। এক ঘণ্টার নৌকাবিহারের শেষে মনে হয়, এমন কেন সত্যি হয় না রোজ।
দ্বিতীয় সকালে প্রথম ঠিকানা প্যারিসের বৃহত্তম প্লেস ‘দ্যে লা কনকর্ড’ বা কনকর্ড স্কোয়ার। অষ্টভুজাকৃতি স্কোয়ারের প্রতি কোনায় একটি করে মূর্তি। ফ্রান্সের এক-একটি শহরের নামে তাদের নামকরণ। ঠিক মাঝখানে ফরাসি বিপ্লবের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক। তার পাশের অদ্ভুত সুন্দর ঝরনাখানা জল ঝরিয়ে চলেছে অবিরত। যে মিউজিয়াম ঘিরে পারি শহরের আভিজাত্য, সেই ল্যুভর মিউজিয়াম কি না দেখলে চলে? কনকর্ড স্কোয়ারের বুক চিরে যাওয়া ল্যুভরের পথে। দু’টি কাচের পিরামিডের একটিকে আর একটির উপরে উল্টো ভাবে বসালে যে চেহারা হয়, ল্যুভরের আকৃতিও ঠিক তেমন। দিনের সব সময় মিউজিয়াম চত্বর লোকের ভিড়ে গমগম করছে। এখানেই সযত্নে রক্ষিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ববিখ্যাত ‘মোনালিসা’। ঠোঁটের কোণে স্মিত অথচ রহস্যময়ী এক হাসি নিয়ে সে আমাদের জানাল সাদর অভ্যর্থনা। এর পাশাপাশি বিবিধ পেন্টিং আর ভাস্কর্যের আকর দেখলে মনে হবে, কোনও জাদুকর তাঁর জাদুকাঠির ছোঁয়ায় এই শিল্প সৃষ্টি করেছেন। এমনই জীবন্ত সব কাজ! পাক্কা আড়াই ঘণ্টা ঘোরার পরে একটু জিরিয়ে নিতে যখন দাঁড়ালাম, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। খাওয়া সেরে নেওয়া মিউজিয়াম চত্বরের ভিতরে রেস্তোরাঁয়। খাওয়া শেষ হতে মনে হল, প্যারিসে এসেও ‘নোতরদাম ক্যাথিড্রাল’ দেখব না, তা কি হয়? শহরের মাঝখানে মাথা তুলে গথিক স্থাপত্যের এই মাস্টারপিস। ভিতরে ঢোকার অবশ্য অনুমতি নেই। অগত্যা বাইরে থেকেই নোতরদাম ক্যাথিড্রালকে বুড়ি ছুঁয়ে ক্যামেরা হাতে দে দৌড় ‘পালে দ্যু ভার্সাই’-এর উদ্দেশে। এর বাঙালি নাম ‘ভার্সাই প্যালেস’। স্থানীয় গাইডকে নিয়ে সেখানে যখন পৌঁছনো গেল, সূর্যের পশ্চিমে ঢলতে দেরি আছে। প্রাসাদের একটি অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। সোনালি রঙের বিশাল লোহার গেট দিয়ে প্রবেশ অবশ্য নিষেধ। আমাদের ঢুকতে হবে পাশের ছোট একটি গেট দিয়ে। ‘কোর্ট ইয়ার্ড’-এর যা আয়তন, একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হয়ে যাবে। একে একে ঘুরে দেখা নাচমহল, রাজদরবার, বৈঠকখানা থেকে শুরু করে রাজা-রানির নিজস্ব কক্ষ।
প্রাসাদের সামনে যে বাগান, তা যেন সবুজ এক ক্যানভাস! সেখানে নানা ডিজাইনের গাছ যেন কেউ তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে। এর পরে বাসে চেপে যাওয়া সেই স্বপ্নের মিনার, আইফেল টাওয়ার। টিকিট কাউন্টারের সামনে দিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়েছে সাপের মতো লাইন। লিফ্টের পাশাপাশি টাওয়ারের মাথায় ওঠার জন্য আছে সিঁড়িও। ৬০০টি সিঁড়ি পার হয়ে ওঠা যাবে দ্বিতীয় লেভেল পর্যন্ত। লাইন পেরিয়ে লিফ্টে করে শেষ পর্যন্ত যখন মাথায় ওঠা গেল, সামনের দৃশ্য দেখে আর চোখ ফেরানো যায় না। যত দূর চোখ যায়, প্যারিসের ‘চির উন্নত শির’। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে লা স্যেন। গাড়ি ও মানুষজনকে ঠিক পিঁপড়ের মতো লাগছে। ওখানে দাঁড়িয়েই যেন সারা ক্ষণ কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় তো নেই। এক সময়ে নামতেই হয়। নীচে নেমে আকাশপানে মাথা তুলে ‘দ্য আয়রন লেডি’কে মনে মনে কুর্নিশ করলাম। সারা দিনের সফর শেষে যখন হোটেলের পথে, বিকেলের সূর্য মেদুর হয়ে আইফেল টাওয়ারের চূড়া ছুঁয়েছে।

ছবি: সুপ্রিয়া রায়




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.