পথের সাজে
...সাজাব যতনে

কাশ্মীরি ঝুমকো, রংচঙে কাঠের দুল-বালা-নেকপিস, পাথর-বসানো গয়নার সেট, ফ্যান্সি দুল-হার, ফিউশন গয়না ফ্যাশন বলছে এ সবই এখন ‘ইন’। এ দিকে, ব্র্যান্ডেড বা বড় দোকানের গয়না কিনতে বাদ সেধেছে পকেট কিংবা মন? সেখানেই ভরসা ফুটপাথ। পাশের শো-রুমের জানলায় রাখা দেড় হাজারি সেট দেড়শো টাকায় অনায়াসে হাতের নাগালে, সঙ্গে আশ মিটিয়ে দরকষাকষির সুযোগ নামী দোকানের দামি গয়নার ধাঁচে গয়না কিনতে ফুটপাথের সারি সারি ছোট্ট দোকানগুলোয় তাই উপচে পড়ে ভিড়। মিলেমিশে এক সাধ আর সাধ্য।
ঝুটো গয়না। তাই জেল্লা কম, তেমন টেঁকসই নয় তবে ফ্যাশনে ‘হিট’ দুল বা বালাটাই তো! উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কেনাকাটায়, তন্বী কলেজছাত্রী থেকে রাশভারী স্কুলশিক্ষিকার পছন্দে, স্কুলপড়ুয়ার পকেটমানি থেকে রোজগেরের শখ মেটানোয় তাই অনায়াসে সামিল হয়ে পড়ে ফুটপাথের গয়না। “ঠিক এইটাই ইউএসপি ফুটপাথের দোকানগুলোর,” বলছিলেন জুয়েলারি ডিজাইনার রোহিতা ভাস্করন। তাঁর কথায়, “হালফ্যাশনের গয়নাকে সবার সাধ্যের মধ্যে পৌঁছে দিতে ফুটপাথ একটা বড় ভূমিকা নেয়। এই দোকানগুলোর গয়না যেহেতু ট্রেন্ডে থাকা গয়নার ধাঁচেরই, তাই ফ্যাশন মেনে সাজতে পারছেন উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সকলেই এটাও তো খুব ভাল ব্যাপার।”
শুধু কি দামে সস্তা এবং দরকষাকষির সুযোগটাই ফুটপাথে ভিড় টানে? “মোটেই না, ট্র্যাডিশনাল গয়না হোক বা আধুনিক জাঙ্ক জুয়েলারি, জমকালো সেটই বা ছিমছাম গয়না কলকাতার ফুটপাথে সবই থাকে। কোথাও এথনিক গয়নার সম্ভারটাই বেশি, কোথাও আবার ফ্যাশনেবল গয়না। কোনটা কোথায় ভাল মেলে, খবর রাখলেই হল!” বলছেন ব্যস্ত কর্পোরেট অস্মিতা মুখোপাধ্যায়। ঢাকুরিয়ার মোড়ে একটি শপিং কমপ্লেক্সের বাইরে হাতে গোনা চার-পাঁচটা ঝুপড়ি দোকান। বাঁকুড়া-বীরভূমের কাঠ, ডোকরা, হাঁসুলি, টেরাকোটা, পুঁতির এথনিক গয়না থেকে দস্তা, বিড্স, প্লাস্টিক, সেরামিক, জার্মান সিলভার, ব্ল্যাক মেটাল, অক্সিডাইজ্ডের জাঙ্ক জুয়েলারি চাইলে ঢুঁ মারতেই পারেন। আছে শান্তিনিকেতনী ধাঁচের নানা রঙের কাঠের দুল-হার, বিড্স বা ডোকরার লকেট লাগানো পলতের উপরে রঙিন সুতোয় গাঁথা নেকপিস, টেরাকোটা, ডোকরার দুল-হারের মতো ট্র্যাডিশনাল গয়না, আছে জার্মান সিলভার, বিড্স, সেরামিকের হার-দুলের সেট, দস্তা, অক্সিডাইজ্ডের ঝুমকো বা অন্য কায়দার দুল। সঙ্গে কাঠ, প্লাস্টিক, সুতো বা পাথর বসানো চুড়ি-বালা, কাঠের বিড্সের স্প্রিং ব্রেসলেটের আধুনিক অথচ এথনিক গয়না। একটি দোকানের কর্ত্রী সঞ্জু পাত্র জানালেন, কাঠের গয়না, পলতে হার বাড়িতেই তৈরি। ডোকরা বা বিড্সের লকেট বাঁকুড়া-বীরভূম-ওড়িশা থেকে আনানো। অন্য সব দুল, হার বা সেট সবই দিল্লি বা বড়বাজার থেকে কিনে আনা। সঞ্জু এবং পাশের আর একটি দোকানের কর্মী দীনেশ হালদার জানালেন, পুজোয় জার্মান সিলভারের সেটের চাহিদা থাকলেও বছরভর ডোকরা বা মাটির ও কাঠের গয়নার দিকেই ঝোঁকেন ক্রেতারা। তবে সেট বা মালার চেয়ে দুলের চাহিদা বেশি থাকে বরাবরই। গড়িয়াহাটের ফুটপাথ জুড়ে সম্ভারটা মূলত ফ্যান্সি গয়না বা স্লিক জুয়েলারির। সোনালি বা রুপোলি রঙের ড্যাঙ্গলার, টপ, নানা আকারের তারের দুল, অক্সিডাইজ্ড, ব্ল্যাক মেটাল বা প্লাস্টিকের ‘ফাঙ্কি’ গয়না, পাথর বসানো ঝুমকো, হার-দুলের সেট, বালা এবং কাঠ, প্লাস্টিক, বিড্স ও সুতোর বালার সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট স্লিক ডিজাইনের লকেটের সোনালি-রুপোলি চেন মিলবে দেদার। বিভিন্ন দোকানের তরফে কানাই দে, বাপি ঘোষ, অমিত হাজরা, তুষার মাইতিরা জানালেন, তাঁদের পসরা আসে মূলত বড়বাজার থেকে। আরও জানালেন, পুজোর ফ্যাশনে এ বার ‘হিট’ ছিল কাশ্মীরি ঝুমকো। তবে, পুজো বা বিয়ের মরসুমে সেটের চাহিদা বেশি থাকলেও সারা বছরই ভাল বিক্রি ফ্যান্সি দুল আর ছোট্ট লকেটের ছিমছাম চেনের। পাশে দাঁড়ানো কলেজছাত্রী পৃথা তরফদার, প্রয়াঙ্কা দে, আদৃতা রায়দের দলটাও ঠিক সেগুলোই দেখাতে বলছিলেন তখন।
আর যদি ঝকমকে গয়নাই বেশি টানে? হাতিবাগান মোড় থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত একের পর এক দোকানে সোনালি, রুপোলি দুল-হার-চুড়ি-বালা, নানা রঙের পাথর বসানো ঝলমলে গয়নার সেট চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। বিভিন্ন দোকানে নিরঞ্জন সাউ, দিলীপ নন্দী, তপন দাসরা কেউ পসরা সাজান ক্যানিং স্ট্রিট, কেউ বড়বাজার, কেউ বা মহাজনের থেকে কেনা গয়নায়। সকলেই জানালেন, ফ্যাশন বুঝে রাখতে হয় আধুনিক কায়দার কাঠের বা ডোকরার গয়না, প্লাস্টিক, মেটাল বা সুতোর বালাও। তবে চাহিদা বেশি ঝকমকে গয়নারই। তবে ইদ, পুজো বা বিয়ের মরসুমেই ঠাসাঠাসি ভিড় থাকে দোকানে। আর একটি ব্যবসায়ী শ্যামল সিংহ অবশ্য জানান, তাঁর দোকানে খিদিরপুর থেকে কিনে আনা থাইল্যান্ডের বিড্সের মালা, মুম্বই থেকে আনানো পাথর বসানো সেট সোনালি-রুপোলি সেট, মিনে করা লকেট বসানো মুক্তোর সেট বছরভর দেদার বিকোয়।
ঝকমকে দুল, হার বা মিনে করা সেট, কাশ্মীরি ঝুমকো থেকে কাঠ বা বিড্সের গয়না, ডোকরার লকেট বসানো মালা, হালফ্যাশনের স্প্রিং ব্রেসলেট বা পাথর বসানো বালা সব যদি চান এক দোকানেই? নিউ মার্কেটের লাগোয়া রাস্তা জুড়ে পরপর দোকানে তারই পসরা। তিন-চার জন তরুণী প্রায় হুমড়ি খেয়ে বাছছিলেন নানা রঙের কাঠের দুল। যাদবপুরের প্রকৃতি সেনগুপ্ত, সল্টলেকের তৃণা সাহারা তখন কোমরবেঁধে দরদাম করছেন লাল-সবুজ পাথর বসানো কাশ্মীরি ঝুমকোর জন্য। একটি দোকানের তরফে কে আলি জানান, মুম্বইয়ের রংবেরঙের পাথর বসানো সোনালি বা রুপোলি গয়নার চাহিদা থাকে সারা বছর। পুজোয় অবশ্য বেশি চলেছে কলকাতাতেই তৈরি কাঠের গয়নাও। আজাদের দোকানের গয়না আসে মূলত বড়বাজার থেকে। জানালেন, ঝকমকে গয়নার পাশাপাশি নানা রঙের কাঠের চাকতি গাঁথা লম্বা হারের দিকেই ঝোঁকেন ক্রেতারা।
ফ্যাশন মেনেই তো গয়না সাজায় ফুটপাথের দোকানগুলো। তা হলে বিভিন্ন ফুটপাথে পসরা এমন আলাদা কেন? রোহিতা বলছেন, “সংস্কৃতি থেকে সাজ-সচেতনতা, গয়নার পছন্দ সবের উপরেই নির্ভর করে। বিভিন্ন এলাকায় ক্রেতাদের পছন্দ তথা চাহিদার ফারাকেই তাই এই বৈচিত্রটা তৈরি হয়। পাশাপাশি, ব্যবসায়ীরা যে বাজার থেকে গয়না সংগ্রহ করেন, সেটাও এ সব দোকানের পসরায় প্রভাব ফেলে।” আর এক ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পালের কথায়, “ঢাকুরিয়ায় পাশের শপিং কমপ্লেক্স থেকে কেনা নানা রাজ্যের ট্র্যাডিশনাল শাড়ি-কুর্তার সঙ্গে ম্যাচ করে গয়না কেনা বাঙালি ক্রেতারাই ভিড় জমান। গড়িয়াহাটের ক্রেতারা আবার মূলত ফ্যাশন সচেতন বা স্কুল-কলেজের পড়ুয়া। নিউ মার্কেটে এথনিক গয়না কিনতে চাওয়া পর্যটক বা ট্রেন্ডি সাজের খোঁজে আসা টিনএজারদের ভিড়, তাই দু’রকম গয়নাই থাকে পসরায়। হাতিবাগানে আবার অবাঙালি বেশি, তাই পাথর বসানো গয়নার চাহিদা বেশি। পছন্দের এই ফারাকগুলোই এক-একটা ফুটপাথের পসরাকে নিজস্ব একটা পরিচিতি দেয়। যাঁরা ফুটপাথের গয়না কেনেন, তাঁরা জানেন কী কিনতে কোথায় যেতে হবে।”
অস্মিতারাও তো ঠিক এটাই করেন!




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.