কুহেলিকা আর গ্যাদগেদে সত্যি মিশে গিয়ে।
অবিশ্বাস্য-বিশ্বাস্য একই মোহনায় জড়ো হয়ে যাওয়ায়।
মায়াজাল এবং বাস্তব একে অপরকে জাপটাজাপটি করে ধরায়।
শুক্রবার ভারতীয় ক্রিকেটে প্রায় ভুতুড়ে, অলৌকিক আর অভূতপূর্ব এক অধ্যায় গেল! অধ্যায় মানে আটত্রিশ মিনিটের শর্ট ফিল্ম। কখনও তা সুখী পরিণতি সমন্বিত ছায়াছবির মতন ওয়াংখেড়ে আকাশে দেখাচ্ছিল আম আদমির স্বর্ণসিংহাসনে অভিষেক। কখনও জাদুকরি প্রদর্শনীর প্রসন্নতা। কখনও উচ্চাশাপূরণ আর উত্তেজনার বড় বড় ঢেউতে মনকে অন্য সড়কে নিয়ে ফেলা। আর শেষমেশ শেক্সপিয়ারীয় মহানাটকের বিষণ্ণতায় ঝুপ করে গোটা মাঠকে ঢেকে দেওয়া!
বলা হচ্ছিল স্বর্গভ্রমণে উত্থিত হওয়ার জন্য শহর মুম্বইকে আর মাত্র ৩৩ সিঁড়ি ভাঙতে হবে। স্বয়ং শহরের রাজপুত্র যে নিরানব্বই সেঞ্চুরি হাতে নিয়ে ৬৭ ব্যাটিং। বাকি রানগুলো স্রেফ চুকে যাওয়ার নিয়মরক্ষা। তার পর ব্যাটিং ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর শহরও স্বর্গোত্থিত হবে।
স্রেফ ওই তেত্রিশ সিঁড়ি কভারেজে এ দিন সকালে মুম্বই বিমানবন্দরে নামা ইস্তক মনে হতে লাগল, শহরটা যেন রোজকার চেহারায় নেই। ফিনফিনে যে হাওয়া চলছে তা-ও যেন অভ্যাগতকে বলছে, আজ শততম সেঞ্চুরির বিশেষ দিনে ও পর্যটক, আপনি এই শহরে স্বাগতম। গাড়িতে যেতে যেতে মাহিম ক্রস করেছি কি না, বিশাল বিশাল সচিনের পোস্টার। সঙ্গে শুভেচ্ছা জাস্ট করে ফ্যালো! শিবাজি পার্ক পৌঁছেছি এ বার। তেন্ডুলকরের ধাত্রীভূমি। ততক্ষণে গাড়ির রেডিওতে শুনছি প্রবল পরাক্রমে সকালটা শুরু করেছেন তেন্ডুলকর। ২+৪+১+৪=৭৮ খুব দ্রুত হয়ে গেল। শিবাজি পার্কের গণেশ মন্দিরের সামনে ভিড়। সত্যি কি না জানি না, ওটা নাকি সচিনের জন্য গণপতির কাছে নীরব প্রার্থনা। যতক্ষণ তিনি ক্রিজেভিড় থাকবে। আর মেরিন ড্রাইভের ওপর তো জলোচ্ছ্বাস। চির ঢেউহীন আরব সাগরের জল ফুটপাথে ওঠার প্রশ্ন নেই। ঢেউ এসেছে দশ নম্বর লেখা সচিন-জার্সির সমাহারে। টেলিভিশনের ওবি ভ্যানগুলো কাছাকাছি পার্ক করা।
ও দিকে সচিন ক্রিজে। এ দিকে তাঁর পাগল ভক্তেরা হিস্টিরিয়া আসক্তের মতো আছড়ে পড়ছে টিভি ক্যামেরার সামনে। এই করতে করতে সচিন ৯৩। প্রচণ্ড মারছেন। বাইরে থাকা ভিড় এ বার দৌড়তে শুরু করল গেটের দিকে। বিশেষ মুহূর্তটা কে-ই বা ছাড়তে চায়। এদের সঙ্গে প্যাভিলিয়নমুখী গেট-বরাবর ছুটতে গিয়ে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। কার্ড-টার্ড না দেখিয়েই বোর্ড অফিসের বড় গেট দিয়ে ঢুকে গেলাম। এমন নজরদারির বাজারে মুম্বইয়ের মাঠে কেউ কিছু চেক করল না। মেটাল ডিটেক্টরের সামনে ফেলল না ওই ভিআইপি এলাকায়। স্বপ্নেও দেখার উপায় নেই। কিন্তু বললাম না, শুক্রবার একটা অদ্ভুতুড়ে দিন। রক্ষীরা কার্ড দেখবে কী, সব পিছনে ফিরে মাঠের খবর নিচ্ছে। রেডিও হাতে কাউকে দেখলে পাশে দাঁড় করাচ্ছে। সচিনের সেঞ্চুরি-প্রার্থনায় তো গোটা দেশের সঙ্গে তারাও সমাহিত।
|
পশ্চিম দিকের গ্যালারিতে উঠে এ বার দেখা গেল ফুটন্ত ডিস্কোথেক। সব হেলছে-নাচছে-গাইছে। বিরাট কোহলির দিকে চেঁচাচ্ছে, ওহে, সিঙ্গলস নিয়ে তোমার মাস্টারমশাইকে খেলতে দাও। কে বলবে মুম্বই কর্মনাশা শহর নয়। আর শুক্রবার সকাল দশটায় এত লোকের এখানে থাকার মানে এক দিনে সব সি এল গেল। টেস্ট ক্রিকেট মৃতপ্রায় তখন দেখলে কারও মনেই হত না। বরং মনে হত, শততম ঘিরে এমন জাতীয় আকুতি, যেন এটা হলেই ভারতীয় টাকার ধ্যাড়ধ্যাড় করে দর বাড়বে। বেকারত্ব নির্মূল হয়ে যাবে। জিনিসপত্রের দাম এমন কমে যাবে যে, নেতাকে চপেটাঘাতের পরিবর্তে অপরিচিত গোলাপফুল বুকে গুঁজে দেবে। নিও স্পোর্টসে তখন শাস্ত্রী কমেন্ট্রি করছেন। বিশপের শেষ হব-হব। তার আগে প্রোডিউসার গাওস্করকে নিয়ে এলেন। বিশেষ মুহূর্তটার সময় যাতে শাস্ত্রী-গাওস্কর পার্টনারশিপ থাকে।
ঠিক এ রকম চূড়ান্ত মধুচন্দ্রিমায় মাখামাখি মুহূর্তে তেন্ডুলকর আউট হয়ে গেলেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে আউট হন গারওয়াড়ে ক্লাবহাউসের দিকে। এ দিন প্রেসবক্স এন্ড-এ। তা-ও কী কুৎসিত স্ট্রোক! খেলার তিনি স্টিয়ারিং ধরে নিয়েছেন সেই সকাল থেকে। স্রেফ সিঙ্গলসে সেঞ্চুরি বেরিয়ে যায়। অথচ ব্যাকফুট ড্রাইভ করতে গেলেন এমন শর্ট অব লেংথ ডেলিভারিতে যা তাঁকে শট নেওয়ার যথেষ্ট জায়গা দেয়নি। বলের হাইটটাও তিনি ম্যানেজ করতে পারেননি। মাথা নিচু করে হেলমেট হাতে সচিন অপস্রিয়মাণ। মাঠ এমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত যেন বার্থ ডে বয়-কে কেক, মোমবাতি আর কার্ড পাশে রেখে সবে হ্যাপি বার্থ ডে গাইতে শুরু করছিল। আচমকা পুলিশ এসে তুলে নিয়ে গেল বার্থ ডে বয়-কে।
রাগটা প্রাথমিক ভাবে গিয়ে পড়ল রবি রামপলের ওপর। আউট করেছিস, করেছিস। এতটুকু সৌজন্য নেই তোর! জানিস গোটা ভারতের আশার দীপ নিভিয়ে দিয়েছিস। তার পর সেই বিষাদের ওপর উল্লাস করছিস। এর পর টার্গেট হয়ে গেলেন রামপল। পেস বোলার স্পেল শেষে আউটফিল্ডে দাঁড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মাঠের যেখানে যাচ্ছেন, লোকে অশ্রাব্য গালাগাল করছে। রবি শাস্ত্রী যা দেখে বিস্ফারিত, “তেন্ডুলকরকে আউট করে যদি নাচানাচি না করে, তা হলে কখন করবে? ক্রাউডের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?”
ধোনি নেমে পড়েছেন খানিকক্ষণ হল। কিন্তু কেউ তো আর সকাল দশটা আটের পর থেকে খেলা দেখছে না। বরঞ্চ খেলা দেখার চেয়ে বেশি জরুরি এসএমএস চালাচালি শুরু হয়েছে। ওয়াংখেড়ে উদ্ধৃত হতাশা থেকে গোটা আসমুদ্রহিমাচলে। নমুনা এসএমএস: কিষেনজি ধরা পড়তে পারেন। পেট্রোলের দাম কমে যেতে পারে। ঐশ্বর্যা বেশি বয়সে প্রসব করে ফেলতে পারেন। কিন্তু সচিনের জন্য ভাগ্য যেন অধরা। ভিআইপি বক্সে অর্জুন তেন্ডুলকর খেলা দেখতে এসেছিল। দেখতে আসার মতোই দিন। সাতাশির বিশ্বকাপে যে ছেলে ভারতের ম্যাচে এ মাঠের বলবয় ছিল, সে আজ কিনা ব্যাটসম্যানশিপের অমরত্বে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু ফটোগ্রাফাররা যখন অর্জুনকে আবিষ্কার করলেন, তখন ভেঙে পড়া মুখের ছবিরই প্রাসঙ্গিকতা। কেউ কেউ অঞ্জলিকে খুঁজছিলেন। তাঁরও তো বিদীর্ণ মুখচোখ থাকার কথা!
এমন রঙিন, চকচকে ছিল একটু আগে মাঠটা। দ্রুতই মনে হতে লাগল কেউ তার ওপর শোকের ইয়া বড় সাদা আলখাল্লা টাঙিয়ে দিয়েছে। টেস্ট ম্যাচ চলছে। কিন্তু সাদা কাপড়ে মোড়া শ্রাদ্ধবাসরে। সচিন কাঙ্গা লিগ খেলতেন যাঁদের সঙ্গে, এমন কিছু অনামী মুখকে ওয়াংখেড়েতে কাতর দেখাল। “৮৫, ৯১, ৭৬ আর আজ ৯৪পরের পর সেঞ্চুরি চলে যাচ্ছে। লক্ষণ ভাল নয়। একশো আদৌ আসবে তো?” বললেন এঁদের এক জন। মঙ্গেশ আধতরাও আর এক জন। আচরেকরের দলে সচিনের ক্যাপ্টেন ছিলেন মঙ্গেশ। খার জিমখানায় পঁচাশি সালে একটা ম্যাচে তিন নম্বরে নামা সচিনকে তিনি ডেকে রান আউট করে দেন। কারণ টিম বড় রান তাড়া করছিল আর আধতরাও ভাবেননি এই সিঁটকে, বাচ্চা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে বড় রান তাড়া করা সম্ভব। অপমানিত সচিন সে দিন ফিরে যেতে যেতে নাগাড়ে ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন। কিন্তু আজ কি আধতরাও কাঁদবেন? বললেন, “যো হুয়া বহুত বুরা হুয়া। আমার ছেলে সচিনের ভীষণ ফ্যান। পুরো ভেঙে পড়েছে। আর কী খেলা দেখবে বলুন তো!”
এ জন্যও অদ্ভুতুড়ে দিন। যে দিন ৯৪ রানেও জনতা হতাশায় ভেঙে পড়ছে। বলছে যথেষ্ট নয়। ক্রিকেট এক বলের খেলা। একটা বলের ভুলে শৌর্য মড়মড় ভেঙে পড়ে। যেমন পড়ল আজ। এ সব শুনতে-টুনতে কেউ রাজি হচ্ছে না। শততম সেঞ্চুরি চাই। যেখান থেকে পারো নিয়ে এসো এই হল সরব চাহিদা। ২৫৭ দিন আগে শেষ সেঞ্চুরি এসেছে সচিনের ব্যাটে। আরও যত দিন যাবে চাপ বাড়বে যে, তোমার ক্রিকেট ব্যাট হঠাৎ করে বন্ধ্যা হয়ে গেল কী ভাবে?
বিশেষজ্ঞরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন যে, এই মারাত্মক চাপ বয়ে নিয়ে যদি তেন্ডুলকরকে অস্ট্রেলিয়া যেতে হয়, টিমের ওপর মারাত্মক বোঝা হয়ে যাবে। তার চেয়ে প্রার্থিত সেঞ্চুরিটা এখানেই হয়ে যাক। ওয়ান ডে থেকে আসুক। তার পর না হয় হালকা মেজাজে অস্ট্রেলিয়ায় যান। বিকেলে দু’জন টিভি ভাষ্যকারকে আলোচনা করতে শুনলাম, প্রথম তিনটে ম্যাচ সচিন অন্তত খেলুক। তার মধ্যে প্রথম ম্যাচেই হয়তো হয়ে যাবে। কটকে।
তাঁরা জানতেন, এখানে সেঞ্চুরি হলে সচিন কিছুতেই ওয়ান ডে খেলতেন না। কারণ সচিনের পরিকল্পনাও ছিল, ওয়ান ডে একেবারে না খেলে টেস্ট সিরিজে কাজটা নামিয়ে দেওয়া। কিন্তু কেউ ভাবেননি সেঞ্চুরির হাহাকার চলতে থাকা অবস্থাতেও ওয়ান ডে ম্যাচ যে সচিন এড়িয়ে যাবেন। পরিচিত-অপরিচিত সবার মনে হচ্ছিল, ওপেন করে ওয়ান ডে-তে সেঞ্চুরির অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তাটা তিনি নিজের জন্য রাখবেন।
সচিন কি তা হলে ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলা ছেড়েই দিলেন? বিশ্বকাপ ফাইনালের পর একটা ওয়ান ডে ম্যাচেও তাঁকে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। শুক্রবার এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। কিন্তু এটুকু বোঝা গেল, শততম সেঞ্চুরির মতোই জীবনের শেষ অস্ট্রেলিয়া সফরকে উত্তুঙ্গ গুরুত্ব দিচ্ছেন তেন্ডুলকর। তিনিই প্রথম লোক যিনি বোর্ডকে প্রস্তাব দেন, আমি আগে যেতে চাই। প্রথম ম্যাচের আগে সাত দিন ওখানে অনুশীলন করতে চাই। ঠিক যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের আগে খাপ খাওয়াতে আগাম ও দেশে চলে গেছিলেন, তেমনই কয়েক জন সতীর্থ নিয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়া। সম্ভবত ৮ ডিসেম্বর যাত্রা। কারণ পরের দিন থেকে মেলবোর্নের ‘ল্যাঙ হ্যাম’ হোটেলে (টেস্টেও ভারতীয় টিম হোটেল) সচিনের বুকিং রয়েছে।
একশো সেঞ্চুরির দুর্লঙ্ঘ মনুমেন্ট তৈরি। আর ডনের দেশে নিজের গজদন্ত মিনার অক্ষত রাখা। বোঝা গেল দুটোকে আলাদা বিভাগে সরিয়ে রেখেছেন তেন্ডুলকর। দুটো উচ্চাশাই ধাওয়া করছেন সমান্তরাল ভাবে। একটা ব্যক্তিগত মহাকীর্তির। একটা ক্রিকেটীয় চির-মর্যাদার। এ দিন ওয়াংখেড়ে ড্রেসিংরুমে দেখছিলাম, অভীষ্টের মাত্র ৬ রান আগে ফিরিয়ে দেওয়া ভ্রমাত্মক ব্যাকফুট ড্রাইভটাই বারবার শ্যাডোতে ঠিক করছিলেন। বাজি ধরছি, সকালের নেট-এ এটা সচিনের মেনুতে প্রথম থাকবে। আর কে বলতে পারে, ব্যাকফুট পাঞ্চেই শততম একশো ঘটবে না? সে দেশটা যেখানেই হোক! আটত্রিশ মিনিটের শর্ট ফিল্মের বিয়োগান্ত পরিণতিকে তাই দিনের বিয়োগান্ত শেষ শট বলা যায় কি না প্রশ্ন থেকে গেল। সচিনকে টুকরোটাকরা দেখে মনে হল, বাকি ৬ রানের হাহাকারটা সত্যি। পাশাপাশি সত্যি ওয়াংখেড়ে-পরবর্তী নতুন সকালে শততম সেঞ্চুরির জন্য নতুন প্রতিজ্ঞা!
মায়াজাল আর বাস্তব শুরুতেই তো বললাম বারবার মিশে একটা অনির্বচনীয় চালচিত্র তৈরি করছে, যে নামে ইচ্ছে তাকে ডাকুন। ক্রিকেট বলতে পারেন! রহস্য বলতে পারেন! জীবন বলতে পারেন! ক্রিকেট অদৃষ্টই হয়তো ঠিক করে রেখেছে জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি যার বিদেশে, জীবনের পঞ্চাশতম টেস্ট সেঞ্চুরি যার বিদেশে, তার শততমও হবে বিদেশে। খোদ ডনের দেশে। এমন স্ক্রিপ্টকে কী নামে ডাকবেন?
|