|
|
|
|
লারউডের মতোই নিন্দিত হয়ে থাকলেন এ যুগের ডন-ঘাতক |
সুমিত ঘোষ • মুম্বই |
ওয়াংখেড়েতে শুক্রবার সেঞ্চুরির প্রত্যাশা ছিল। হয়েছে।
ওয়াংখেড়েতে শুক্রবার ২ এপ্রিলের মতো বিজয়-উৎসব হওয়ার কথা ছিল। হল না। উল্টে রাত পর্যন্ত শোকযাপন আর বিলাপ চলছে।
ওয়াংখেড়েতে শুক্রবার জাদুকরি মাইলস্টোন হওয়ার কথা ছিল। নজিরবিহীন না হলেও মাইলস্টোন হয়েছে।
ওয়াংখেড়েতে শুক্রবার সেই মাইলস্টোন নিয়ে সমুদ্রগর্জন ছাপিয়ে জয়ধ্বনি ওঠার কথা ছিল। ওঠেনি।
সচিন তেন্ডুলকর এবং রবিচন্দ্রন অশ্বিন ক্রিকেটের সাপলুডো খেলার দুই বিরল চরিত্র হয়ে থাকলেন আরব সাগরের পারে। এক জন শততম সেঞ্চুরির কাছাকাছি এসেও জনতার হৃদস্পন্দন প্রায় থামিয়ে দিয়ে গেলেন সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৬ রান দূরে থেমে গিয়ে। ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে সাপের মুখে পড়ার মতো। পরের বার আবার শূন্য থেকে শুরু করার বিধান নিয়ে ফিরে গেলেন।
অন্য জনের সেঞ্চুরির সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কোনও দৃশ্য কারও কল্পনাতে ছিল না। কখন তাঁর সাপের মুখে পড়ে যাওয়ার কথা। তিনি সেঞ্চুরি করে দিয়ে চলে গেলেন। শুধু তাই নয়, অশ্বিন এমন এক বিরল কীর্তিকে ছুঁলেন যা ভারতীয় ক্রিকেটে এমনকী কপিল দেবেরও নেই। দেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার আখ্যা পেয়েও হরিয়ানা হারিকেন যা পারেননি, চেন্নাইয়ের তরুণ স্পিনার তাই করে দেখালেন। জীবনের অভিষেক সিরিজেই। আজ পর্যন্ত ভারতীয় অলরাউন্ডারদের মধ্যে একমাত্র বিনু মাঁকড় এবং পলি উমরিগড় একই টেস্টে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন আর সেঞ্চুরি করেছেন। উমরিগড়েরটা শেষ বার। সেই বাষট্টিতে। অশ্বিন আজ সেই কীর্তি ছুঁয়ে ফেললেন। আশ্চর্যের হচ্ছে, তিনি যে এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়েছেন, অশ্বিন জানতেনই না। কেউ তাঁকে বলেওনি। সন্ধ্যায় হোটেলে ফেরার পর বিস্ফারিত হয়ে বললেন, “ওহ্, তাই নাকি? পলি উমরিগড়ের পর আমি! জানতামই তো না। এটা জেনে খুবই ভাল লাগছে।” |
|
সচিনকে ফিরিয়ে রামপলের হুঙ্কার। |
শুধু ব্যক্তিগত মাইলস্টোনই ছোঁয়া নয়, তাঁর টিমকেও ব্যাট হাতে গর্ত থেকে টেনে তুললেন অশ্বিন। তিনি যখন ক্রিজে এলেন তখনও ফলো-অনের ফাঁড়া কাটেনি। বিরাট কোহলির সঙ্গে জুটি বেঁধে সেই ফাঁড়া কাটালেন। তার পর কোহলি আউট হয়ে যাওয়ার পর টেল-এন্ডারদের নিয়ে লড়াই করে ম্যাচ হারার আতঙ্ক দূর করলেন। তাঁর ১১৮ বলে ১০৩ না থাকলে ভারত প্রথম ইনিংসে ৪৮২ তুলতে পারে না। সব মিলিয়ে এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এগিয়ে ১৮৯ রানে। হাতে আট উইকেট। ড্রয়ের সম্ভাবনা এখন যতটা বেশি দেখাচ্ছে, অশ্বিন ক্রিজে আসার সময় দেখাচ্ছিল না। শেষ দিন সকালে আবার যদি নতুন স্পিন-আবিষ্কার কয়েকটা তুলে নিতে পারেন তা হলে বলা যায় না, ওয়াংখেড়ে আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। অশ্বিন আরও যেটা করলেন— হরভজন সিংহকে প্রবল অন্ধকারে ঠেলে দিলেন। আজকের পর তো হরভজনের মতো তাঁর নামের পাশেও টেস্ট সেঞ্চুরির রং লেগে গেল। সকালে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ওয়াংখেড়ের মন আর কিছুতেই ফেরার ছিল না। তবু জনতার কাছে কিছুটা নাটক আমদানি করতে পারলেন অশ্বিন। যখন শেষ উইকেটে প্রজ্ঞান ওঝাকে নিয়ে সেঞ্চুরির জন্য লড়াই করলেন।
ক্রিকেটীয় সাপ-লুডো এমন জিনিস যে, নব্বইয়ের ঘরে এক বার ব্যাটের পর হেলমেটে লাগিয়ে একটা চার পেলেন অশ্বিন। আর যাঁর সেঞ্চুরির জন্য কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সকাল থেকে প্রার্থনায় বসেছিল, তিনি প্রথম ভুলেই আউট। অমিতাভ বচ্চন পরপর দু’টো টুইট করলেন। প্রথমে লিখেছিলেন, সচিন আউট ৯৫। সেটা সংশোধন করে পরক্ষণেই আবার লিখলেন, ‘সচিন আউট ৯৪। স্টিল হার্টব্রোকেন। কিন্তু সম্পূর্ণ আশা রয়েছে, এক দিন সচিন ওই জায়গায় পৌঁছবে।’
সারা বিশ্বের ক্রিকেটমহল তখন ভূকম্পিত। ডমিনিক কর্ক টুইট করছেন। প্যাট সিমকক্স টুইট করছেন। সঞ্জয় মঞ্জরেকর করছেন। বলিউড অভিনেত্রীরা তাঁদের শোকস্তব্ধতার কথা জানাচ্ছেন।
হার্টব্রোকেন!
|
|
সেঞ্চুরির পর অশ্বিন। ছবি: উৎপল সরকার |
এ দিন ওয়াংখেড়েতে নিঃসন্দেহে এটাই সবথেকে উচ্চারিত শব্দ। আর এমন আচমকা, অপ্রত্যাশিত ভাবে বজ্রপাতটা ঘটল যে, মনে হচ্ছিল ওয়াংখেড়ের রক্ত চলাচলই বোধহয় থেমে গিয়েছে। না হলে ষাটের ঘর থেকে নব্বইয়ের কোটায় সচিনের এ দিনের যাত্রা হালফিলে তাঁর করা সবথেকে ভাল ব্যাটিং প্রদর্শন! কী মোহময়ী ছোঁয়ায় তিনি তখন এগোচ্ছেন! রবি রামপলকে স্ট্রেট ড্রাইভ মারলেন। মনে হল যেন অর্জুনের ধনুক থেকে বেরোনো তির। ফিডেল এডওয়ার্ডসকে অফড্রাইভ। মিড-অফ ফিল্ডারকে দেখে মনে হল যেন তাজমহল দেখছে। নড়ার কী দরকার! চুপচাপ দাঁড়িয়ে অমর সৃষ্টির শোভা উপভোগ করো। আবার এডওয়ার্ডস। এ বার সচিন সেই ঝাঁকড়া চুলের সচিন। শাসকের ঔদ্ধত্য নিয়ে স্কুপ মারলেন। থার্ডম্যানের ওপর দিয়ে ছয়। সম্ভবত টপ গিয়ারে উঠে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আর নামাতে পারলেন না নিজেকে। অতি আক্রমণাত্মক শট নিতে গিয়েই পতন।
কোটলায় ছিলেন দেবেন্দ্র বিশু। এখানে তাঁর ঘাতক হয়ে থাকলেন রবি রামপল। ওয়াংখেড়েকে প্রায় মর্গ বানিয়ে দিয়ে তিনি যখন বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করতে গেলেন, দর্শকদের হতাশা তাঁর দিকে ঠিকরে বেরোল। দিনের খেলা শেষে ক্যারিবিয়ান পেসার বলে গেলেন, “বলতে গেলে আমাকে একপ্রকার হেনস্থাই করা হচ্ছিল তখন। আমি জানি সচিন আউট হয়ে যাওয়ায় সবাই শোকস্তব্ধ। কিন্তু আমিও বা কী করতে পারি! ক্রিকেটে এটাই তো জীবন। কেউ ভাল করতে চাইবে আর কেউ চেষ্টা করবে সেটা আটকানোর। সচিন যেমন সেঞ্চুরি করতে এসেছিল, তেমন আমাদেরও দায়িত্ব ছিল ওকে আউট করার। আমরা তো আর মাঠের মধ্যে ওর জীবন সহজ করে দিতে পারি না। আমাকে আমার কাজ তো করতেই হবে।” আরও বললেন, সকাল থেকে তাঁদের মধ্যে এটা নিয়েই আলোচনা চলেছে। কোচের সঙ্গে কথা বলেছেন। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে বলেছেন। স্ট্র্যাটেজি করেছেন। কী ভাবে সচিনকে আক্রমণ করা যায়। আর নকশাটা এটাই ছিল যে, বাড়তি বাউন্সের খোঁজ করে সচিনকে অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। ঠিক সেটাই ঘটালেন।
|
তিন মূর্তি |
বিনু মাঁকড় |
পলি উমরিগড় |
রবিচন্দ্রন অশ্বিন |
(বনাম ইংল্যান্ড,
লর্ডস, ১৯৫২) |
(বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ,
পোর্ট অব স্পেন, ১৯৬২) |
(বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ,
ওয়াংখেড়ে, ২০১১) |
৭২ ও ১৮৪ রান
৫-১৯৬ ও ০-৩৫ |
৫৬ ও ১৭২ নঃআঃ
৫-১০৭ ও ০-১৭ |
(শুক্রবার পর্যন্ত) ১০৩
৫-১৫৬ ও ০-২০ |
|
“আমরা ফাস্ট বোলার। আমাদের জীবনই এই,” যখন বলছিলেন রামপল, তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন হ্যারল্ড লারউড পরিবারের বংশধর। ব্র্যাডম্যানকে থামিয়েও কখনও বন্দিত হননি লারউড। বরং বডিলাইনের কুখ্যাত খলনায়ক হিসেবেই বরাবর জায়গা পেয়ে এসেছেন ক্রিকেট ইতিহাসে। সারা জীবন ধরে জুটেছে শুধু লোকের ঘৃণা আর ভর্ৎসনা। রামপলের জন্যও আজ তাই বরাদ্দ!
|
ওয়াংখেড়ের স্কোরবোর্ড |
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
প্রথম ইনিংস: ৫৯০
ভারত
প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৮১-৩) |
সচিন ক স্যামি বো রামপল ৯৪
লক্ষ্মণ ক স্যামুয়েলস বো ফিডেল এডওয়ার্ডস ৩২
বিরাট ক ফিডেল এডওয়ার্ডস বো বিশু ৫২
ধোনি বো স্যামি ৮
অশ্বিন ক বারাথ বো রামপল ১০৩
ইশান্ত ক ব্র্যাভো বো স্যামুয়েলস ৫
অ্যারন বো স্যামুয়েলস ৪
প্রজ্ঞান ন.আ. ০
অতিরিক্ত ১০
মোট ৪৮২।
পতন: ৬৭, ১৩৮, ২২৪, ২৮৭, ৩২২, ৩৩১, ৪২৮, ৪৫৫, ৪৬৩।
বোলিং: ফিডেল এডওয়ার্ডস ২৮-৪-১১৬-১, রামপল ২৪.৪-৩-৯৫-৩,
স্যামি ২৬-৩-৯০-২, স্যামুয়েলস ১৭-০-৭৪-৩, বিশু ৪০-৬-১০৬-১।
|
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
দ্বিতীয় ইনিংস |
বারাথ ক লক্ষ্মণ বো প্রজ্ঞান ৩
ব্রাথওয়েট ব্যাটিং ৩৪
কার্ক এডওয়ার্ডস স্টাঃ ধোনি বো প্রজ্ঞান ১৭
ব্র্যাভো ব্যাটিং ২৭
মোট ৮১-২।
পতন: ৬, ৩০।
বোলিং: প্রজ্ঞান ১৫-২-২৭-২, ইশান্ত ৫-২-১২-০, অ্যারন ৩-০-১৪-০,
অশ্বিন ৮-০-২০-০, সহবাগ ২-০-৩-০, সচিন ১-০-৫-০। |
|
|
|
|
|
|
|