শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে খুনে গ্রেফতার আর এক সাংবাদিক। সংবাদ সংগ্রহের প্রতিযোগিতাই এই হত্যার পিছনে কাজ করেছে কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
গত ১১ জুন আততায়ীর গুলিতে খুন হয়েছিলেন মুম্বইয়ের একটি ট্যাবলয়েডের ক্রাইম রিপোর্টার জ্যোতির্ময় দে (জে দে)। সেই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্য একটি ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক জিগনা ভোরাকে আজ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জ্যোতির্ময়ের মতো এই মহিলাও ক্রাইম রিপোর্টার। আদালতে আজ পুলিশ জানিয়েছে, জ্যোতির্ময়ের প্রতি জিগনার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল।
জ্যোতির্ময় হত্যায় মাফিয়া ডন ছোটা রাজনের হাত রয়েছে বলে গোড়া থেকেই সন্দেহ করছিল পুলিশ। ইতিমধ্যেই ছোটা রাজন গোষ্ঠীর ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে তারা। পুলিশের অপরাধদমন শাখার একটি সূত্রের দাবি, জিগনা ভোরার সঙ্গেও ছোটা রাজনের যোগাযোগ ছিল। জ্যোতির্ময়ের মোটরবাইকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, তাঁর বাড়ি ও অফিসের ঠিকানা, প্রতিদিনকার যাতায়াতের রাস্তা এই সব তথ্য রাজনকে জিগনাই দিয়েছিলেন বলে পুলিশ মনে করছে।
গত ৫ নভেম্বর চার্জশিট দায়ের করার জন্য অপরাধদমন শাখাকে ৩০ দিন বাড়তি সময় দিয়েছিল বিশেষ ‘মকোকা’ (মহারাষ্ট্র কন্ট্রোল অফ অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যাক্ট) আদালত। পুলিশ আদালতকে বলেছিল, জিগনার ভূমিকা খতিয়ে দেখার জন্যই তাদের বাড়তি সময় দরকার। আজ মুম্বই পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধদমন শাখা) হিমাংশু রায় ঘোষণা করেন, “এই হত্যার ষড়যন্ত্রে একটি ইংরেজি দৈনিকের মুম্বই ব্যুরোর উপপ্রধান জিগনা ভোরার হাত রয়েছে।” আদালত জিগনাকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
মুম্বই শহরতলির পওয়াইয়ে নিজের বাড়ির কাছেই খুন হন জ্যোতির্ময়। অন্ধকার জগৎ নিয়ে খবর করা সাংবাদিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম জে দে-র হত্যা তোলপাড় ফেলেছিল গোটা দেশে। অনেকে সন্দেহ করেছিলেন তেল মাফিয়াদের। কারণ, কোঙ্কন উপকূল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ঘুরে তেল পাচার চক্রের খবর জোগাড় করেছিলেন জ্যোতির্ময়। আবার অনেকে বলেছিলেন, মুম্বইয়ে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডে’র দিন ফিরে এসেছে। তদন্ত যত এগিয়েছে, মুম্বইয়ের সেই কুখ্যাত অন্ধকার জগতের দিকেই ঘুরে গিয়েছে সন্দেহের তির। উঠে এসেছে ছোটা রাজনের নাম। দেখা গিয়েছে, এক ক্রিকেট জুয়াড়ি-সহ যে ১০ জন গ্রেফতার হয়েছে, প্রত্যেকেই ছোটা রাজন গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত।
তা সত্ত্বেও তদন্তের সব চেয়ে অপ্রত্যাশিত মোড় হয়তো বা এক সাংবাদিক হত্যা মামলায় আর এক সাংবাদিকের গ্রেফতার হওয়াই। পুলিশকে উদ্ধৃত করে একটি দৈনিক বলেছে, জ্যোতির্ময় খুন হওয়ার আগে ছোটা রাজনের সঙ্গে জিগনার বহু বার ফোনে কথা হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। যদিও আদালতে জিগনার কৌঁসুলি আজ বলেন, জিগনা যে ছোটা রাজনের সঙ্গে জে দে বা তাঁর খুন নিয়েই কথা বলেছিলেন, তার কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলির দাবি, জিগনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই জ্যোতির্ময়কে খুন করা হয়েছিল বলে তদন্তে জানা গিয়েছে। জিগনা ওই তথ্য সরাসরি ছোটা রাজনকে দিয়েছিলেন, নাকি তার কোনও সহযোগীকে, সেটা জানার জন্যই তাঁকে হেফাজতে চেয়েছে পুলিশ। আগে একাধিক বার জেরার সময় জিগনা পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছেন বলেও দাবি করেছেন সরকারি কৌঁসুলি। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশ জিগনার মোবাইল এবং কম্পিউটার পরীক্ষা করে দেখতে চায়।
কিন্তু জ্যোতির্ময়ের প্রতি জিগনার ‘বিদ্বেষ’ ছিল কেন? যতটুকু জানা গিয়েছে তাতে পেশাগত ঈর্ষার দিকটাই প্রকট হচ্ছে। প্রকট হচ্ছে দুই ‘ক্রাইম রিপোর্টারে’র মধ্যে ‘সোর্স’ নিয়ে দড়ি টানাটানি। পুলিশ এবং ছোটা রাজন গোষ্ঠীর কিছু সূত্র উদ্ধৃত করে একটি সংবাদপত্র বলেছে, ছোটা রাজন-ঘনিষ্ঠ জনৈক ফরিদ তানাশার সঙ্গে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ ছিল জ্যোতির্ময়ের। এ দিকে জিগনাও তানাশার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে থাকেন। গত বছর তানাশার বাড়ির সামনে জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে জিগনার ঝগড়া হয়েছিল। তার পরে ছোটা রাজনের ‘ঘনিষ্ঠ’ হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টায় জিগনা নাকি জ্যোতির্ময়ের দু’টো বাছাই লেখা ই-মেলে পাঠিয়েছিলেন। সেই লেখা পড়ে রাজনের মনে হয়, জ্যোতির্ময় তাকে নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। জে দে-র প্রতি রাজনের বিদ্বেষ সেই থেকেই ঘনাচ্ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। সংবাদসংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, আজ আদালতে ঢুকেই কেঁদে ফেলেন জিগনা। তাঁকে সান্ত্বনা দেন সহকর্মীরা। জিগনার দৈনিকের সম্পাদক হুসেন জাইদি বলেন, “গত কয়েক বছর ধরে ভোরাকে চিনি। ও কোনও ভুল করতে পারে না।” মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার অরূপ পট্টনায়ক অবশ্য বলেছেন, “গ্রেফতার মানেই অপরাধের লক্ষণ নয়। প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ওঁর (জিগনা) একটা ভূমিকা রয়েছে। তদন্তে সত্যিটা জানা যাবে।” |