বিপদ জেনেও দলে নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতিপত্তিবৃদ্ধির ‘শেষ চেষ্টা’ করেছিলেন কিষেণজি। কিন্তু যৌথবাহিনীর হাতে তাঁর মৃত্যুর ফলে সিপিআই (মাওবাদী)-তে আপাতত গণপতি-কিষেণজির গোষ্ঠীকে পিছু হটতে হবে বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা।
২০০৪-এর ২১ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন পিপলস ওয়ার গ্রুপ (পিডব্লিুউজি বা জনযুদ্ধ) এবং মাওইস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার (এমসিসি) মিলে গিয়ে তৈরি হয়েছিল নতুন দল ‘সিপিআই (মাওবাদী)।’ এবং সেই পত্তনকালেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে বিরোধের সূত্রপাত। এক দিকে তাত্ত্বিক নেতা কিষাণদা ওরফে প্রশান্ত বসুর গোষ্ঠী। অন্য দিকে গণপতি-কিষেণজিরা। এমসিসি থেকে আসা কিষাণদাদের মূল লক্ষ্য ছিল মূলত আদর্শের উপরে দাঁড়িয়ে দলের গণ-ভিত্তি বাড়ানো। আর জনযুদ্ধের সদস্য গণপতি-কিষেণজিদের ভাবনায় ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের পথে ক্ষমতা দখল।
পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রের গোয়েন্দা-পুলিশ সূত্রের খবর: খুনের রাজনীতির বিরোধিতা করে মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটিতে কিষাণদার গোষ্ঠী একদা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সরকার বদলের পরে চাকা ঘুরতে শুরু করে। এক শীর্ষ গোয়েন্দা-কর্তার ব্যাখ্যা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার গোড়ায় জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান কার্যত স্তব্ধ রেখে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জোর দেয়। পাশাপাশি মধ্যস্থ নিয়োগ করে চলে শান্তি প্রক্রিয়া। কিষাণদা-গোষ্ঠীর বক্তব্য ছিল, এ হেন পরিস্থিতিতে খুনের রাজনীতি চালিয়ে গেলে সংগঠনের গণ-ভিত্তিতে ধস নামতে বাধ্য। কারণ, শান্তি-আলোচনা ও খুনোখুনি এক সঙ্গে চলতে পারে না।
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটিতে কিষাণদা গোষ্ঠীর এই তত্ত্ব ক্রমে গুরুত্ব পেতে থাকায় কিষেণজি-গণপতিরা কোণঠাসা হতে শুরু করেছিলেন। কিষেণজির প্রভাব বেশি মূলত বাংলা-বিহার-ওড়িশায়। নেতৃত্বের ‘সঙ্কটে’ পড়ে তিনি ভেবেছিলেন, এই তিন রাজ্যে সক্রিয় কর্মী ও মানুষের মধ্যে প্রভাব বজায় রাখতে পারলে দলীয় নেতৃত্বেও ভারসাম্যের পরিবর্তন হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁরাই আবার প্রাধান্য পাবেন। মূলত এই উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যেই কিষেণজি দু’দিন আগে ফের পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে আসেন বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
কিন্তু ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। |
মাওবাদী নেতারা কে কোথায় |
পলিটব্যুরো সদস্য |
বেণুগোপাল রাও (ভূপতি) দন্তেওয়াড়া, ছত্তীসগঢ়
প্রশান্ত বসু (কিষাণদা) রাঁচি-পূর্ব সিংভূম, ঝাড়খণ্ড
মল্লরাজ রেড্ডি (সাথেন্না) নওপাড়া, ওড়িশা |
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য |
পুল্লুরিপ্রসাদ রাও (চন্দ্রন্না) বিজাপুর, ছত্তীসগঢ়
রামচন্দ্র রেড্ডি (প্রতাপ) নারায়ণপুর, ওড়িশা |
কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিটির সদস্য দেবকুমার সিংহ (অরবিন্দজি) লাতেহার, ঝাড়খণ্ড |
*গোয়েন্দা সূত্রের শেষ খবর |
|
শান্তি প্রক্রিয়া চলাকালীনই জঙ্গলমহলে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ায় যৌথবাহিনী যে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রী যে মাওবাদীদের প্রতি কঠোর মনোভাব নিচ্ছেন, সে খবর কি কিষেণজির কাছে ছিল না?
গোয়েন্দা-সূত্রের অনুমান, দলে নিজের গোষ্ঠীর অবস্থান মজবুত করতে কিষেণজি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাই বিপদ জেনেও ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার তথ্য: গত বুধবার কিষেণজি তিরিশ জনের একটি দল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকেন। কুশবনির জঙ্গলে পুলিশের তাড়া খেয়ে দলটি তিন ভাগে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে যায়। একটা দল যায় মালাবতির দিকে। একটি কাকমারি জঙ্গলে। কিষেণজির নেতৃত্বে তৃতীয় দলের ঠিকানা ছিল জামবনির বুড়িশোল জঙ্গল।
কিন্তু গত ক’মাসে জঙ্গলমহলে তাঁদের প্রতি মানুষের সমর্থনে যে কতটা ভাটা পড়েছে, ওই মাওবাদী নেতা সম্ভবত তা আঁচ করতে পারেননি। পুলিশের দাবি: যে গ্রামবাসীরা এত দিন মাওবাদীদের ‘চোখ-কানের’ ভূমিকা পালন করেছেন, নিরাপত্তাবাহিনী সম্পর্কে গেরিলাদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, তাঁরাই এখন মাওবাদীদের গতিবিধির খবর নিরাপত্তাবাহিনীকে পৌঁছে দিচ্ছেন। সেই ভাবে কিষেণজির আগমনের খবরও পৌঁছে যায় যৌথবাহিনীর কাছে। উপরন্তু কুশবনি থেকে পালানোর সময়ে ধরা পড়া তিন মাওবাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিষেণজির অবস্থান সম্পর্কে একশো শতাংশ নিশ্চিত হয় পুলিশ।
অন্য দিকে কিষেণজিও জেনে গিয়েছিলেন, বুড়িশোল জঙ্গলে তাঁদের উপস্থিতি যৌথবাহিনীর কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: পরবর্তী কৌশল স্থির করতে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ অন্য দু’টো দলকে তিনি সেখানে ডেকে নেন। বিকেলে শুরু হয় সেই গুলির লড়াই। মৃত্যু হয় কিষেণজির।
গোয়েন্দামহলের অনুমান: মাওবাদী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিটব্যুরো ও মিলিটারি কমিশনের সদস্য মাল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজির মৃত্যুর পরে সংগঠনের ইস্টার্ন রিজিওনাল ব্যুরোর দায়িত্বে আসবেন প্রশান্ত বসু ওরফে কিষাণদা, যিনি আদতে কি না যাদবপুরের লোক। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্র পুলিশের গোয়েন্দা-কর্তাদের এ-ও অনুমান, কিষেণজির অবর্তমানে গণপতি-গোষ্ঠী আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে, ফলে ফের বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তাদের খুনের রাজনীতিও। এমনকী, কিষেণজির মৃত্যুর প্রেক্ষিতে মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটিতে ‘ফাটল’ ধরার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ। ফেব্রুয়ারির মধ্যে মাওবাদীদের পার্টি কংগ্রেস হওয়ার কথা। গোয়েন্দাদের মতে, ব্যাপারটা সেখানেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বস্তুত মাওবাদীদের বাগে আনতে গোয়েন্দারাও এখন পার্টি কংগ্রেসেরই অপেক্ষায়। কেন?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসেবে, কিষেণজির মৃত্যুর পরে মাওবাদী পলিটব্যুরোর ছ’জন এখনও প্রশাসনের নাগালের বাইরে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যেও ২২ জনের নাগাল মেলেনি। তবে গোয়েন্দাদের দাবি: ইদানীং মোবাইল, ই-মেল বা স্যাটেলাইট ফোনের সূত্র যে ভাবে তাদের হদিস দিয়ে দিচ্ছে, তাতে মাওবাদীরা আতঙ্কিত। অনেক ক্ষেত্রে দলের শীর্ষনেতারা নিচু ও মাঝারি স্তরের ক্যাডারদের উপরেও পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। যে কারণে ছত্তীসগঢ়ের আবুঝমাঢ় জঙ্গলের বাইরে যে সব পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা রয়েছেন, তাঁদের অনবরত ঠিকানা বদলাতে হচ্ছে। এঁদের অধিকাংশেরই বয়স পঞ্চাশের উপরে। কিন্তু জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করতে হলে ওঁদের গোপন ঘাঁটি থেকে বেরোতেই হবে। আর তখনই ওঁদের কব্জা করার ‘সুবর্ণ’ সুযোগ হাতে আসবে বলে আশায় আছেন নর্থ ব্লকের নকশাল দমন বিভাগের কর্তারা। |