মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে, যত তাড়াতাড়ি কাজ চাইছেন, তাঁর প্রশাসন কি তা ‘করে উঠতে’ পারছে? রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগকে ঘিরে এই প্রশ্নটাই এখন প্রকট হয়ে উঠেছে।
পুজোর আগে টাউন হলে সভা ডেকে কয়েকশো জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়। গ্রামে গিয়ে কাজ করার জন্য ‘উদ্বুদ্ধ’ করার পাশাপাশি মমতা তাঁদের বলেছিলেন, পুজোর আগেই নিয়োগপত্র পৌঁছে যাবে বাড়িতে। তাঁরা যেন যত দ্রুত সম্ভব কাজে যোগ দেন। রসিকতাচ্ছলে সে দিন নতুন ডাক্তারদের ‘মায়ের জন্য পুজোর শাড়ি’ কিনে নিয়ে যেতেও বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
দুর্গাপুজো পেরিয়ে গিয়েছে। কালীপুজো, ভাইফোঁটাও পার। এখনও নিয়োগপত্র হাতে পাননি এক জন চিকিৎসকও। কবে পাবেন, সে সম্পর্কেও স্বাস্থ্য দফতর তাঁদের কিছু জানাতে পারেনি।
ফলে তরুণ চিকিৎসক মহলে সংশয় ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। যেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজে সব সময়ে কাজে গতি আনায় জোর দিচ্ছেন, সেখানে ‘আঠারো মাসে বছরের’ এই কর্মসংস্কৃতি কবে বদলাবে, সে প্রশ্নও তুলছেন ওঁদের অনেকে। টাউন হলের সভায় মুখ্যমন্ত্রী তরুণ চিকিৎসকদের আরও একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কোনও প্রলোভনেই তাঁরা যাতে সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে বেসরকারি চাকরিতে পা না-বাড়ান, সে জন্য তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখিয়েছিলেন নানা স্বপ্ন। ছিল গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির প্রতিশ্রুতিও। সেই চিকিৎসকেরা এখন বলছেন, “খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরেও যদি নিয়োগপত্র পেতে এমন হাল হয়, তবে আমরা কোন ভরসায় অন্যান্য প্রতিশ্রুতিতে ভরসা রেখে কাজে যোগ দেব?
কেন এই বিলম্ব?
স্বাস্থ্য-কর্তারা স্বভাবতই অস্বস্তিতে। ওঁদের যুক্তি: নিয়োগকে ‘যুক্তিসঙ্গত’ করতে গিয়েই দেরি হয়ে গিয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই ডাক্তারদের কাছে চিঠি পৌঁছে যাবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে স্বাস্থ্যভবন। কিন্তু যে কোনও নিয়োগই যে ‘যুক্তিসঙ্গত’ হবে, সেটাই স্বাভাবিক! এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী সময়সীমা ঘোষণার পরেও সেই ‘যুক্তিসঙ্গত’ পদ্ধতিটি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শেষ হল না কেন?
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার ব্যাখ্যা: “নিয়োগের ক্ষেত্রে এ রাজ্যে বছরের পর বছর কোনও নিয়ম মানা হয়নি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব সত্ত্বেও বহু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে অ্যানাস্থেটিস্ট কিংবা শিশুরোগ চিকিৎসককে রেখে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁদের যথোপযুক্ত জায়গায় বহাল করা হবে। আর তাঁদের জায়গায় যাবেন নতুন জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারেরা।” উপরন্তু দীর্ঘ দিন গ্রামে ‘পড়ে থাকা’ ডাক্তারদের শহরে আনার ব্যবস্থাও হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা।
গ্রামে-গঞ্জে ডাক্তারের অভাব বহু পুরনো সমস্যা। আবেদন-নিবেদন কাজে না-আসায় বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতেও রাজ্য সরকার পিছপা নয়। পাশাপাশি গ্রামে কর্মরত সরকারি চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হচ্ছে। টাউন হলের ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ডেকেছিলেন প্রায় ৭০০ চিকিৎসককে। সকলেরই বিভিন্ন জেলায় জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার পদে যোগ দেওয়ার কথা। শীর্ষ স্বাস্থ্য-কর্তারা তখন জানিয়েছিলেন, অনেকে যদি শেষ মুহূর্তে গ্রামে যেতে বেঁকে বসেন, তা হলেও অন্তত ৪০০ জন নিশ্চিত ভাবে গ্রামে গিয়ে কাজ করবেন।
কিন্তু তাঁদের নিয়োগপত্র নিয়েই এ হেন এমন জটিলতা সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। নিয়োগপত্রের আশায় বসে থাকা এক চিকিৎসক জানাচ্ছেন, তাঁদের ইন্টার্নশিপ শেষ হয়ে গিয়েছিল ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে ইন্টারভিউ হয়ে যায়। মনোনয়নের খবরও আসে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে। তবে ওই পর্যন্ত। তার পরে বিধানসভা ভোটের ডামাডোলে পুরো বিষয়টাই চাপা পড়ে গিয়েছে।
নবীন চিকিৎসকের কথায়, “নতুন সরকার গঠনের পরে মুখ্যমন্ত্রী নিজে আমাদের ডেকে কথা বলায় খুব আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ নিয়োগপত্র আসবে তো?”
নিয়োগ-বিভ্রান্তির কথা মেনে নিচ্ছেন চিকিৎসক সংগঠনের নেতারাও। তৃণমূল প্রভাবিত ‘প্রগ্রেসিভ সার্ভিস ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি নিমাই নাথ বলেন, “অনেক তরুণ চিকিৎসক বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইছেন। এক বার শুনেছিলাম, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য দেরি হচ্ছে। এখন কী অবস্থা, আমিও ঠিক জানি না।” সিপিএম প্রভাবিত ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ হেল্থ সার্ভিস ডক্টরস’ও এই ‘ঢিলেমি’র নিন্দা করেছে। |