|
|
|
|
বলরামপুরে নিহত দুই |
মাওবাদীদের মদত দিলেও ব্যবস্থা, হুঁশিয়ারি মমতার |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও পুরুলিয়া |
মাওবাদীদের প্রতি আগেই তিনি ‘কড়া মনোভাব’ দেখিয়েছিলেন। মাওবাদীদের যাঁরা ‘ইন্ধন’ দিচ্ছেন বা ‘গুণকীর্তন’ করছেন, এ বার তাঁদের প্রতিও ‘কড়া বার্তা’ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, এই কাজ যাঁরা করবেন তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, নির্দিষ্ট করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক এবং কিছু ছাত্রছাত্রী এ সব কাজে যুক্ত বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ঘটনাচক্রে, এ দিনই মাওবাদীদের তরফে এক চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকারের সঙ্গে ‘অস্ত্র সংবরণ চুক্তি’ ভেঙে দিল তারা।
সোমবার সন্ধ্যায় পুরুলিয়ার বলরামপুরে দু’জন খুন হওয়ার খবর আসার পরেই কড়া প্রতিক্রিয়া জানান মুখ্যমন্ত্রী। গত শুক্রবার বলরামপুরে সভা করেছেন তিনি। তার পরে এই খুন। এ দিন খবর পাওয়ার পরে তাঁর কড়া মন্তব্য, এ সব খুনোখুনিতে কলকাতা থেকেই ‘মদত’ দেওয়া হচ্ছে। মমতা বলেন, “টাকাপয়সা দিয়ে এখান থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন অধ্যাপক এ সবে ইন্ধন দিচ্ছেন।” ‘মাতঙ্গিনী মহিলা সমিতি’ এবং ‘অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-এর নামোল্লেখ করেও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ছাত্র, যুব, শ্রমিক সংগঠনের নামে, বিভিন্ন গণসংগঠনের নামে এ সব করানো হচ্ছে। ভুল বুঝিয়ে ওরা ছাত্র-যুবদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে।” অতঃপর মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি, “যারা মাওবাদীদের মদত দেবে, গুণকীর্তন করবে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |
পাশাপাশি, জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর অভিযান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “ভোটের আগে সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তাই মধ্যস্থতাকারীদের কমিটি গড়েছি। যাতে ওরা (মাওবাদীরা) সৎ পথে ফিরে আসতে পারে। পাঁচ মাস সময় দিয়েছিলাম। ওরা সুযোগ নিতে পারেনি।” তিনি কি যৌথবাহিনীকে এখনই অভিযান শুরু করতে বলবেন? মুখ্যমন্ত্রীর জবাব, “যৌথবাহিনীকে আমি কোনও নির্দেশ দিই না। পুলিশকেও কিছু বলি না। ওরা আইন অনুসারেই চলবে।” তবে রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা জানিয়ে মমতা বলেন, আজ, মঙ্গলবার কলেজ স্কোয়্যার থেকে তৃণমূলের ছাত্র-যুব কর্মীরা ‘ধিক্কার মিছিল’ করবেন।
ঘটনা হচ্ছে, অস্ত্র সংবরণ নিয়ে এ দিনই সুজাত ভদ্র-সহ মধ্যস্থতাকারী কমিটির সব সদস্যের প্রতি এক চিঠিতে মাওবাদীরা জানিয়েছে, ‘সরকার ও আপনাদের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিশ্রুতি রক্ষিত না হওয়ার সাথেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হল’। চিঠিটি লেখা সিপিআই (মাওবাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক আকাশের নামে। মাওবাদীরা ‘অস্ত্র সংবরণ চুক্তি’ শুরু করেছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। মেয়াদ ছিল ১ নভেম্বর পর্যন্ত। মধ্যস্থতাকারীদের তরফে সুজাতবাবু এবং মাওবাদীদের তরফে আকাশ চুক্তিতে সই করেন। আকাশের নামে পাঠানো এই চিঠিটির তারিখ ৩১ অক্টোবর।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেন, “এই চিঠি বিশ্বাস করি না। আমরা জানি না, সমুদ্র না বাতাস কে আকাশের নাম করে চিঠি দেয়! এরা কোটি কোটি টাকা চুরি করে আর সুপারি-কিলারের মতো খুন করে।” ‘অস্ত্র সংবরণ চুক্তি’-কেও মমতা কখনও গুরুত্ব দেননি। গত মাসে ঝাড়গ্রামের সভাতেই তিনি মাওবাদীদের সাত দিনের চরমসীমা বেঁধে দেন। সেই সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনী ‘কাজ’ শুরু করে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। যার জেরে রবিবার গ্রেফতার হন জ্ঞানেশ্বরী-কাণ্ডে অভিযুক্ত জনগণের কমিটির নেতা অসিত মাহাতো।
তৃণমূল কর্মী জিতু সিংহ খুন হওয়ার পরে গত শুক্রবার বলরামপুরেই সভা করে মাওবাদীদের কার্যত ‘চ্যালেঞ্জ’ দিয়েছিলেন মমতা। তাদের ‘জনবিচ্ছিন্ন’ করার জন্য গ্রামে-গ্রামে ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার ডাকও দিয়েছিলেন। সেখানেই এ দিন সন্ধ্যায় খুন করা হয় ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’ তথা তৃণমূলে যোগ-দেওয়া স্থানীয় নেতা রাজেন সিংহ সর্দারের বাবা ও ভাইকে। যে ঘটনায় পুলিশ প্রাথমিক ভাবে মাওবাদীদেরই দায়ী করেছে। রাজেন একদা আদিবাসী-মূলবাসী জনগণের কমিটিতে ছিলেন (যা প্রশাসনের মতে, মাওবাদীদেরই প্রকাশ্য সংগঠন)।
ওই দু’জনের খুনকে সরাসরি ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজ বলে উল্লেখ করে মমতা বলেন, “ওদের (মাওবাদীদের) আমি রাজনৈতিক কর্মী বলে মনেই করি না। ওরা সন্ত্রাসবাদী! হাতে গোনা ৫০-১০০টা লোক বন্দুক নিয়ে ঘুরছে। তাদের চিহ্নিত করে বন্দুক কেড়ে নেব। এই খুনের রাজনীতি চলতে দেব না। এটা আমার চ্যালেঞ্জ!”
এ দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ বলরামপুরের খুনটাঁড় গ্রামে রাজেনের বাবা অজিত সিং সর্দার (৬১) ও তার ছোট ভাই বাকু সিং সর্দারকে (২২) খুন করা হয়। প্রাথমিক স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অজিতবাবু এলাকায় ‘মাস্টার’ নামেই পরিচিত ছিলেন। অযোধ্যা পাহাড়ের উপর যে ছতড়াজেড়া প্রাথমিক স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেছেন, তা মাওবাদীদের ‘মুক্তাঞ্চল’ হিসাবেই পরিচিত। রাজেনকে দলের ‘সক্রিয় কর্মী’ দাবি করে পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “রাজেন এক সময় আদিবাসী মূলবাসী কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আমাদের দলের কর্মী। খুনটাঁড় ও লাগোয়া এলাকায় রাজেন আমাদের দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর সভায়ও রাজেনের নেতৃত্বে প্রচুর লোক এসেছিল।”
শান্তিবাবুর অভিযোগ, “মাওবাদীদের পায়ের তলার মাটি ক্রমশ সরছে। হতাশা থেকেই তারা রাজেনকে না পেয়ে নিরীহ বৃদ্ধ ও তাঁর ছেলেকে খুন করল।” অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েতের খুনটাঁড় গ্রামে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ১২-১৩ জন সশস্ত্র মাওবাদী হানা দেয় রাজেনের বাড়িতে। রাজেন বাড়িতে থাকলেও পালিয়ে যেতে পারেন। তাঁকে না-পেয়ে তাঁর বাবা ও ভাইকে গুলি করে মেরে পাহাড়ের দিকে চলে যায় মাওবাদীরা। যাওয়ার আগে বাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেয়। কাছাকাছি এলাকাতেই ছিল যৌথবাহিনী। আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ বলেন, “বিক্রমের নেতৃত্বে ১৪-১৫ জনের একটি দল হামলা চালায়। ঘটনার পরেই পুলিশ এলাকা ঘিরে ফেলে। দু’পক্ষের গুলির লড়াইও শুরু হয়।” রাত পর্যন্ত গুলির লড়াই চলে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। উন্নয়ন এবং রাজনীতির অস্ত্রে মাওবাদীদের ‘বিচ্ছিন্ন’ করার কথা বলরামপুরের সভায় বলেছিলেন মমতা। তবে পরের পর ঘটনায় এলাকায় যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, তা ‘উন্নয়ন-বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’র সম্পাদক সন্তোষ মাহাতোর কথায় স্পষ্ট, “এ ভাবে চলতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী বা তৃণমূল নেতাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। এলাকার মানুষ কি প্রাণের বিনিময়ে উন্নয়নে সামিল হবেন? প্রশাসন কিছু না-করলে আমরা দল-সংগঠন ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবব।” মন্ত্রী শান্তিবাবু বলেন, “জরুরি ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব।”
তিনি কথা বলার আগেই অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী তাঁর ‘কড়া’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মাওবাদীদের ‘কড়া বার্তা’ দেওয়ার পাশাপাশি মমতা এমনও বলেছেন, “সিপিএমের হার্মাদরা ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কেশপুরে কারা সিপিএমের হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছিল? এই মাওবাদীরাই দিয়েছিল!”
উল্টো দিকে, মাওবাদীদের চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে দেখা করতে এবং কথা বলতে ইচ্ছুক। ‘অস্ত্র সংবরণ চুক্তিকে’ রাজ্য সরকার ‘মান্যতা’ দিয়েছিল এই মর্মে সরকারের লিখিত ব্যাখ্যা পেতেও তারা আগ্রহী। সুজাতবাবুও বলেন, “চুক্তির সময়সীমার মধ্যে মাওবাদীরা কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায়নি। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভারতের কোথাওই এই সমস্যার সমাধান করা যায়নি। সরকারকে ধৈর্য ধরে আলোচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।” মাওবাদীরা দু’টি চিঠি পাঠিয়েছে। একটি সুজাতবাবু-সহ মধ্যস্থতাকারী কমিটির সব সদস্যের প্রতি। অন্যটি শুধু সুজাতবাবুকে। প্রশাসনিক অভিযানের পাশাপাশি দল হিসেবে তৃণমূলও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই জারি রাখছে। জঙ্গলমহলে যুব কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে একের পর এক সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। তিনি জানান, ১৭ নভেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইল ব্লকের কেশিয়াপাতায় দলের যুব কর্মীদের নিয়ে সমাবেশ হবে। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়-সহ জেলার বিধায়করা ওই সমাবেশে থাকবেন। মাওবাদী মোকাবিলায় জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত গ্রামের যুবশক্তিকে প্রশিক্ষিত করা হবে বলেও তিনি জানান। মাওবাদীদের নাম না-করে শুভেন্দু বলেন, “মুখে গামছা বেঁধে, হাতে বন্দুক নিয়ে জঙ্গলমহলে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পরপর গরিব মানুষকে খুন করছে। তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন ব্লকে যুবকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।” এর মাধ্যমে জঙ্গলমহলে শান্তিস্থাপন ও উন্নয়নমূলক কাজে সেখানকার যুবকর্মীদের সামিল করা যাবে বলে আশা শুভেন্দুর। |
|
|
|
|
|