কপাল কেটে রক্ত পড়ছে রোগীর। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর আত্মীয়দের ভিড়। কিন্তু কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তার রোগীর মাথায় ব্যান্ডেজ করতে পারছেন না।
কেন?
কারণ, গজ, তুলোই যে নেই হাসপাতালে। নেই সেলাই করার সরঞ্জামও।
• বারবার শৌচাগারে গিয়ে রোগীর শরীরে জলের ভাগ কমে গিয়েছে। তাঁকে আনা হয়েছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। স্যালাইনের বোতল রয়েছে। কিন্তু রোগীকে তা দেওয়া যাচ্ছে না।
কেন?
কারণ, সুচ নেই।
• ক্ষতস্থান পরিষ্কার না-করলে ব্যান্ডেজ করা যাচ্ছে না। কিন্তু ক্ষত সাফ করা যাচ্ছে না।
কেন?
কারণ, জরুরি বিভাগে স্পিরিটই যে নেই। স্পিরিট দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার না-করে চিকিৎসক ব্যান্ডেজ বাঁধবেন কী করে?
• এখনই রোগীকে ইঞ্জেকশন না-দিলেই নয়। কিন্তু দেওয়া যাচ্ছে না।
কেন?
কারণ, সিরিঞ্জ নেই। |
এই আস্ত ‘নেই-রাজ্য’ কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতাল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ।
কিন্তু এই ‘নেই’-এর কথাটা রোগীর আত্মীয়দের জানানোর সাহস কোথায় জুনিয়র ডাক্তারের? সঙ্কটাপন্ন রোগীর আত্মীয়দের গজ, তুলো, সুচ বা স্পিরিট কিনে আনতে বললেই গণ্ডগোল। এক সপ্তাহের মধ্যে দু’রাতে সেখানে রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসক-নিগ্রহ তারই ফল।
শুক্রবার হাসপাতাল-চত্বরে ধর্নায় বসা চিকিৎসকদের হাতে ছিল নানা ধরনের প্ল্যাকার্ড। তাতে রয়েছে পরিকাঠামোর অভাব নিয়ে অভিযোগ। বৃহস্পতিবার রাতে এক বৃদ্ধ রোগীর মৃত্যুর জেরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের উপরে হামলা হয়। তার পরেই জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি আন্দোলন শুরু করেন। শুক্রবার সারা দিন ওই হাসপাতালে কাজে যোগ দেননি তাঁরা। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা ও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার বৈঠকেও কর্মবিরতি তোলা যায়নি। এমনকী অন্যান্য হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তরদের অনেকেই এই কর্মবিরতিকে সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, পরিকাঠামোর দুর্দশার জেরে যে-কোনও সময় এমন অবস্থা হতে পারে তাঁদেরও। এই আন্দোলনের জেরে এ দিন কার্যত চিকিৎসা পরিষেবাই বন্ধ ছিল ন্যাশনালে।
মঙ্গলবার রাতে ওই হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ তরুণীর চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে ডাক্তারদের মারধর করা হয়েছিল। সে-রাতেই কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। কর্তৃপক্ষ আলাপ-আলোচনায় তাঁদের নিরস্ত করেন। কিন্তু এক দিন পরেই, বৃহস্পতিবার রাতে এক বৃদ্ধ রোগীর মৃত্যুর পরে ফের মারধর করা হয় ডাক্তারদের। তার পরেই শুরু হয় কর্মবিরতি। জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে কর্মবিরতি তোলা হবে না। কারণ, সামগ্রিক ভাবে পরিকাঠামোর যা অবস্থা, তাতে যে-কোনও দিন, যে-কোনও সময়েই তাঁদের নিরাপত্তা ফের বিঘ্নিত হতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রী জেলা সফর সেরে কলকাতায় ফিরবেন আজ, শনিবার রাতে। তার আগে আলোচনা সম্ভব নয়। জুনিয়র ডাক্তার ছাড়া এই সময়টা হাসপাতাল চলবে কী ভাবে?
পরিস্থিতির সামাল দিতে ঠিক হয়েছে, মহানগরীর অন্য সরকারি হাসপাতাল থেকে জরুরি ভিত্তিতে মেডিক্যাল অফিসারদের এনে ন্যাশনালের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হবে। স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, ওই চিকিৎসকেরা শনিবার সকালেই ন্যাশনালে গিয়ে কাজে যোগ দেবেন। জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি না-ওঠা পর্যন্ত ওই চিকিৎসকদের ন্যাশনালেই থাকতে হবে।
জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির আন্দোলনের খবর পেয়ে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার ওই হাসপাতালে যান। হাসপাতালের অধ্যক্ষ, সুপার ও সিনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েকের বৈঠকের পরে তিনি বলেন, “চিকিৎসকদের উপরে এ ভাবে রোজ রোজ হামলা হলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। পুলিশ নিষ্ক্রিয়। সৈনিক বোর্ডের নিরাপত্তারক্ষীরাও ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। এঁদের বদলাতে হবে।”
জুনিয়র ডাক্তারেরা কিন্তু সে-কথায় সন্তুষ্ট হননি। তাঁদের দাবি, আগে হাসপাতালে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব মেটাতে হবে। সেটাই হাসপাতালের মূল রোগ। ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রীর সরবরাহ কোনও সময়েই স্বাভাবিক থাকে না। কর্তৃপক্ষকে বারবার অভিযোগ জানিয়েও ফল হয় না। হাসপাতালের সুপার পার্থ প্রধান স্বীকার করেছেন, গজ, ব্যান্ডেজ, স্পিরিটের সরবরাহ একটু কম আছে। কিন্তু ওষুধ রয়েছে যথেষ্টই।
কেন সরবরাহ কম, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি তিনি।
চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে শুক্রবার সকালেও ন্যাশনাল-চত্বরে এক প্রস্ত বিক্ষোভ হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে ন্যাশনালে ভর্তি হয়েছিলেন উচ্চ রক্তচাপের রোগিণী আয়েশা বেগম (৫৭)। তাঁর পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, দিনভর তাঁর কোনও চিকিৎসাই হয়নি। তাঁর আত্মীয় আব্দুল লতিফের অভিযোগ, এ দিন সকাল সাড়ে ৮টায় হাসপাতালের তরফে তাঁদের জানানো হয়েছিল, আয়েশা ভাল আছেন। তার ঘণ্টাখানেক পরে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার গভীর রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এমনটা হল কেন?
হাসপাতালের সাফাই, এটা সমন্বয়ের অভাব। আর এই সমন্বয়ের অভাবের দায়িত্ব কে নেবে, তা নিয়েও সরব হয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
হাসপাতাল এবং চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের উপরে হামলা বন্ধ করতে বামফ্রন্ট সরকার আইন প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই আইনে কোনও হামলাকারীরই শাস্তি হয়নি। কেন? স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা এই ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকার দিকেই আঙুল তুলেছেন। এ দিন হাসপাতালে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের সমালোচনা করেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাতেও গণ্ডগোলের পরে তিনি বলেছিলেন, “ডাক্তারদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে পুলিশকেই।”
কী বলছে পুলিশ?
লালবাজারের কর্তারা জানিয়েছেন, ওই হাসপাতাল আরও পুলিশ চেয়েছে। তার ব্যবস্থা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালে কর্মরত পুলিশকর্মীরা সংখ্যায় কম হয়ে যাওয়াতেই তাঁরা ঠিক ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারেনননি বলে পুলিশকর্তাদের অভিমত। |