|
|
|
|
মাটির মানুষ |
কেতিকার মলয়কে এক
ডাকে চেনেন গবেষকেরা
অশোককুমার কুণ্ডু • পুরুলিয়া |
|
|
দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনও দিন সে অর্থে আলোকবৃত্তে আসেননি। অথচ, তাঁরা গোটা জীবন ধরে জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে রঙিন করে তুলেছেন। মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা। চিনের সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শ্রীমতী ইয়েন চেন কিংবা আমেরিকার ট্রাইবাল ইউনিভার্সিটির ‘কালামাজু’ বিভাগ থেকে এলিজাবেথ হিল স্টর্ম---সকলেই এক ডাকে চেনেন পুরুলিয়ার কেতকি গ্রামের বাসিন্দা মলয় চৌধুরীকে। কারণ বিভিন্ন সময়ে পুরুলিয়ায় ছৌ নাচ (মাস্ক ডান্স) নয়ে গবেষণা করতে আসা বিদেশি গবেষকদের কাছে মলয়বাবু অন্ধের যষ্ঠীর মতো। আঞ্চলিক ইতিহাস ও ক্ষেত্র সমীক্ষায় নিবেদিত প্রাণ ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। এ সব নিয়ে তাঁর সংগৃহীত তথ্যের ভাণ্ডার যে কোনও গবেষকের কাছেই ঈর্ষণীয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়সের থাবা চেপে বসেছে তাঁর শরীরে। তবুও তিনি আজও সমান আগ্রহী এবং অক্লান্ত নিজের জেলায় লোক সমীক্ষার কাজে। পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা এই জনপদকে উলটে পালটে দেখতে দেখতে তিন দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন মলয়। কিন্তু এ কাজ তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। এ কাজে তো আর অন্ন সংস্থান হয় না। তাই অগত্যা বেছে নিতে হয়েছিল নির্মাণ সংস্থার আংশিক সময়ের কাজ। সে পেশায় আয়ও যৎসামান্য।
তবে এমন জীবিকাও তো পূর্ণ সময়ের হতে পারে না। তাও পুরুলিয়ার মতন ছোট্ট শহরে। কিন্তু উপায় কী। তা ছাড়া মন তো সব সময় কোনও কিছুর অন্বেষণে ব্যস্ত। তাই অন্য কোনও কাজের খোঁজে আর পা এগোয়নি।
“এমনি করেই তো কেটে গেল জীবনের অনেকটা সময়। স্ত্রী ও পুত্র কেন্দ্র সরকারের ডাক বিভাগের কর্মী। ফলে কোনও রকমে সংসার চলে যায়। কিন্তু এত বছরের ভালবাসার কাজ, অঞ্চল ঘুরে ঘুরে ক্ষেত্রসমীক্ষার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গেছি। তা ছাড়ব কী করে? মাঝে মাঝে যে ক্লান্তিকর লাগে না, তা লুকোই কী করে?”---কেতিকার মলয়ের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি।
স্বাভাবিক নিয়মেই তাই জানতে ইচ্ছা করে জীবনের এতটা সময় খরচ করে কী কাজ করলেন?
পুরুলিয়ার লৌকিক দেবদেবী, লোক উৎসব, মাল-বেদে-মাসি সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা বাদ্যকর এবং যাঁরা লোকগান করেন, তাঁদের ওপরে একটি তিনি একটি দীর্ঘ সমীক্ষা করেছেন। সর্বার্থেই ঝুমুর গানের শিল্পী (গান লেখা, সুরারোপ) এবং ভক্তিমূলক ঝুমুরের শিল্পী রামকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ওপর রয়েছে তাঁর একটি অনুসন্ধানমূলক কাজ। আর এর সঙ্গে রয়েছে ছৌ শিল্পীদের গান ও বাজনাকে (যন্ত্র) বিষয় করে কাজটিও মৌলিক। এ সব নিয়ে নানা লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ছোট ছোট পত্রিকায়। কিন্তু নানা কারণে সেই সমস্ত লেখা আর গ্রন্থের আকার পায়নি।
তবে গবেষক মলয় চৌধুরীর সাফল্য অন্য খানে। কেননা বিদেশ থেকে গবেষণা করতে পুরুলিয়ায় যত গবেষক আসেন, তাঁরা সকলেই ঠিক খুঁজে নেন মলয়কে। কারণ? তাঁরা একেবারে কাঁচা, তাই সকলেই আনকোরা কাজ চান। এবং তাঁরা চান ফিল্ড সার্ভে করতে গিয়ে এমন একজনকে, যিনি সেই স্থান ও তার আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে অতি আপনজনের মতোই চেনেন। মলয়ের এই কাজ তাই তাঁদের কাছে সত্যিই বিশেষ গুরুত্বের। আর এ ভাবেই মলয়ের সাহায্যে ও সাহচর্যে তৈরি হয় গবেষণার একটি নতুন দিক। যা তৈরি করে সংস্কৃতির নতুন এক জগতের।
আর সে জন্যই আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিক নাট্য-বিশেষজ্ঞ রবার্ট মাহের এসে খুঁজে নেন মলয়কে। ছৌ-এর ‘নাটক’ কেমন করে ভারতীয় পুরাণ কাহিনীকে গতি দেয় এবং এই আর্টের ফর্ম নাটকে, আধুনিক গ্রিক নাটকে কী ভাবে মেশানো যায়তারই খোঁজে পুরুলিয়া আসা তাঁর। এঁরা দেশে ফিরে যাওয়ার পর কোনও গবেষক পুরুলিয়ায় এলে, তাঁকেও খুঁজে নিতে হয় মলয়কে।
কিন্তু মলয়ের নিজের কাজ মানভূমের সঙ্গীতচর্চার ইতিহাস ‘গানভূম মানভূম’ বা পুরুলিয়ার জাদুচর্চার পাণ্ডুলিপির কী হবে? সবই কি সাগর পেরিয়ে চলে যাবে অন্যের কাছে?
এর উত্তরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না মলয়ের কাছ থেকে। |
|
|
|
|
|