নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আসেননি। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি এসেছেন গৌতম দেব, বিধানসভা নির্বাচনের আগে যিনি নিয়মিত আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তা সত্ত্বেও জাতীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে সূর্যকান্ত মিশ্রকেই বেছে নিল পলিটব্যুরো।
হাসপাতালে শিশুমৃত্যু থেকে ‘দুষ্কৃতী ছাড়াতে’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থানায় চলে যাওয়া, পেট্রোলের দাম নিয়ে কেন্দ্রের শরিক তৃণমূলের ‘নাটক’, বা রাজ্যে হিংসা এ সব নিয়ে কলকাতায় বসে নিয়মিতই সমালোচনা করেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের ফাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনে আজ দেশের রাজধানীতেও সেই কাজটিই করলেন সূর্যকান্ত। তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনের পর দল মনে করছে, সুষ্ঠু ভাবেই নিজ দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।
কী ভাবে? দু’দিন আগে কংগ্রেস-তৃণমূল টানাপোড়েন নিয়ে যে প্রশ্নে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বেসামাল মন্তব্য করে বসেছিলেন, আজ সেই প্রশ্নের জবাবেই মমতার ‘রাজনৈতিক লাইন’ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন সূর্যকান্ত। কেন্দ্রের সঙ্গে মমতার টানাপোড়েন নিয়ে সূর্যকান্তের শ্লেষ, “উনি বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন, কংগ্রেসের দিন ভাল যাচ্ছে না। তাই আগে থেকেই অন্য লাইন ঠিক করছেন। জানি না, এ বার কার সঙ্গে তিনি যেতে চান।”
শিশুমৃত্যু নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বরাবরের জবাব হল, “বামফ্রন্ট সরকার যে অব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছে, তারই ফল ভুগতে হচ্ছে।” আজ দিল্লিতে বসে শিশুমৃত্যু প্রসঙ্গে প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, “আমাদের সময়ে স্বাস্থ্যের অবস্থা যা ছিল, তা খুব গর্ব করার মতো ছিল, বলতে পারি না। কিন্তু শিশুমৃত্যু সমস্যার আরও গভীরে যাওয়া উচিত।” সূর্যকান্তের পরামর্শ, স্বাস্থ্য দফতরের মতো গুরুতর দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী অন্য কাউকে দিয়ে দিন। “তৃণমূলের বিধায়কদের মধ্যে বেশ কয়েক জন চিকিৎসকও তো রয়েছেন। তাঁরাই দায়িত্ব সামলান না!”
সিপিএম মনে করছে, প্রথমে শিশুমৃত্যু, তার পরে পেট্রোলের দাম নিয়ে মমতার সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি, বা মুখ্যমন্ত্রীর ভবানীপুর থানায় চলে যাওয়ার মতো ঘটনা সাম্প্রতিক কালে বার বার জাতীয় সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ফলে বামেরাও সমালোচনার সুযোগ পেয়েছেন। তা কাজে লাগাতেই তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা নিয়ে আজ সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন সূর্যকান্ত। ‘পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের উপর সর্বাত্মক হামলা’ বিষয়ে ১৬ পাতার বিবরণী পেশ করেছেন। তাতে সন্ত্রাস, জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি, পাহাড়ের সমস্যা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেওয়ার অভিযোগ, শিক্ষার উপরে ‘আঘাত’, কৃষি সঙ্কটের মতো অভিযোগেরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
একেজি ভবন সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রকাশ কারাটের ‘প্রিয়পাত্র’ হিসাবে পরিচিত সূর্যকান্তকে আগামী এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেসে নবগঠিত পলিটব্যুরোতেও দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের আসন ধরে রাখতে পেরেছেন, সূর্যকান্ত তাঁদের অন্যতম। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জেলা সভাধিপতি হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। দল ক্ষমতা হারানোর পরে প্রাথমিক ভাবে গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকাই পালন করতে চেয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, বিরোধী দলনেতা হিসেবে সেই ভূমিকায় সফল সূর্যকান্ত। আজ তিনি নিজেও বলেন, “ওঁরা তো বিরোধী পক্ষে থাকার সময় সর্বদলীয় বৈঠকে যোগই দিতেন না। আমরা কিন্তু গিয়েছি। কিন্তু রাজ্যের নামকরণের মতো বিষয় ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যেগুলিতে জরুরি ভিত্তিতে হস্তক্ষেপ করা প্রয়োজন।” সূর্যের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি নয় নয় করে অন্তত ৪০টা চিঠি দিয়েছেন। এক বারই এক লাইনের একটা জবাব পেয়েছেন, ‘আরও বিস্তারিত ভাবে জানান’।
শুধু মমতাকে কটাক্ষ নয়, কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে দলের রণনীতিও জানিয়ে দিয়েছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। প্রশ্ন ছিল, আপনারা কি আশা করছেন তৃণমূল নেত্রী ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেবেন? সূর্যবাবু বলেন, “আমরা আশা-দুরাশা-নিরাশা কিছুই করতে চাই না। আমরা চাই না, কেন্দ্রে এখনই কোনও অস্থিরতা তৈরি হোক। ইউপিএ সরকার জিতে এসেছে মাত্র দু’বছর হল। ওঁরা এখন থাকুন, মানুষের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করুন।” তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে বামেরা কি মনমোহন সরকারকে সমর্থন জানাবে? এই প্রশ্নে সূর্যকান্তের ছোট্ট জবাব, “আমরা বেলাইনে যাওয়ার লোক নই।” |