|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
অর্ধশতকের বাঙালি শৈশব |
আশিস পাঠক |
কমিকস সমগ্র ১ ও ২, নারায়ণ দেবনাথ, সম্পাদনা দেবাশীষ দেব, শান্তনু ঘোষ। লালমাটি, প্রতি খণ্ড ৫০০.০০ হাঁদা ভোঁদা সমগ্র, বাঁটুল সমগ্র, নারায়ণ দেবনাথ। দেব সাহিত্য কুটীর, প্রতিটি ৪৬০.০০ |
ইউদেরজো। বয়স ৮৪। বাহান্ন বছর দুনিয়া-কাঁপানো ‘অ্যাসটেরিক্স’ এঁকেছেন। এ বার যতি টানলেন।
নারায়ণ দেবনাথ। বয়স ৮৬। কমবেশি ষাট বছর ধরে এঁকেছেন বাংলা-কাঁপানো হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে আর ফন্টে...। এখনও এঁকে চলেছেন।
বরং বলা ভাল, চলতে হচ্ছে। ইউদেরজো জানিয়েছেন, অ্যাসটেরিক্স এ বার আঁকবেন নবীন প্রজন্মের কেউ। কিন্তু, নারায়ণ দেবনাথ যদি অবসর নেন? নবীন প্রজন্ম কি তৈরি সেই চ্যালেঞ্জ নিতে?
বড় শক্ত সে চ্যালেঞ্জ। হিসেব করে যদি দেখি, এই ২০১১-য় অ্যাসটেরিক্সের ৫২ বছর, টিনটিনের ৮২, ম্যানড্রেকের ৭৬, ফ্যান্টম বা অরণ্যদেবের ৭৪, মিকি মাউসের ৮২, হাঁদাভোঁদা-র ৪৯, বাঁটুলের ৪৭, নন্টেফন্টে-র ৪২। অর্থাৎ নারায়ণ দেবনাথের সামনেও চ্যালেঞ্জটা ছিল। যে সময়ে তিনি কাজ করেছেন, করে চলেছেন সেই সময়টার প্রায় পুরোটাই রাজত্ব করেছে এবং করছে ভুবনমোহন সব কমিকস। এবং, ভাষার দূরত্বে দুনিয়া কাঁপানোর প্রশ্ন না উঠলেও বাংলাভাষী বিশ্বে নারায়ণ দেবনাথ অদ্বিতীয়।
কিন্তু কমিকসের মহাবিশ্বে সমগ্র নারায়ণ যদি হয় বিপুল এক পৃথিবী, কতটুকু খবর রাখি তার? সাময়িকপত্রের পাতায় দীপ্তি ছড়িয়ে হারিয়ে যায় তারা, বই হয়ে যখন বেরোয় তখনও তার কোনও ইতিহাস কোথাও ধরা থাকে না। তাই প্রথম টিনটিন কিংবা প্রথম অ্যাসটেরিক্সের নাম যত সহজে এসে যাবে ঠোঁটের ডগায় ততটাই অপ্রস্তুত হতে হবে প্রথম বাঁটুলের কথা জিজ্ঞাসা করলে। তাই, নারায়ণ দেবনাথের কমিকস সমগ্র-এর দু’খণ্ড যখন হাতে এল তখন মনে হল এ যেন বাঙালির অর্ধশতকের শৈশবের নতুন এক উদ্যাপন। উদ্যাপন বইয়ের এক ইতিহাসেরও। বাংলায় এত তথ্যপূর্ণ, এত সুবিন্যস্ত কমিকসের সমগ্র সাম্প্রতিক অতীতে আর দেখা যায়নি।
বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদাভোঁদা, নন্টে আর ফন্টে, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, শুঁটকি আর মুটকি, বাহাদুর বেড়াল, পটলচাঁদ দ্য ম্যাজিশিয়ান, পেটুক মাস্টার বটুকলাল-এর মতো ‘জনপ্রিয় মজার কমিক্স’ (এই নামই দেওয়া হয়েছে বিভাগটির, কেন বোঝা গেল না) তো বটেই, এ সমগ্র ধরে রাখতে চেয়েছে নারায়ণের সমস্ত কাজ। অর্থাৎ, ‘অ-জনপ্রিয়’গুলিও বাদ পড়েনি। তারই ফলে এই সমগ্রে প্রায় কোন স্মৃতির অতল থেকে উঠে এসেছে ‘রহস্যময় অভিযাত্রী’, ‘ইতিহাসে দ্বৈরথ’ কিংবা কৌশিকের অভিযান ‘সর্পরাজের দ্বীপে’ও। ‘অ্যাডভেঞ্চার কমিকস’ বিভাগে আছে ড্রাগনের থাবা, অজানা দ্বীপের বিভীষিকা, ইন্দ্রজিৎ রায়ের কাহিনি ব্ল্যাক ডায়মন্ড। আছে বিজ্ঞাপনের কমিকস, ছবির ধাঁধা, নানা রকমের কমিক স্ট্রিপ, কার্টুন স্ট্রিপ। এমনকী, ‘কমিকস সমগ্র’ বললেও, ধরে রাখা হয়েছে নারায়ণবাবুর করা বিভিন্ন প্রচ্ছদ ও অলংকরণও।
পত্রিকা থেকেই মূলত তুলে আনা হচ্ছে কমিকসগুলি, তার মূল চেহারা বজায় রেখে। অর্থাৎ সাদা-কালোয় প্রকাশিত কমিকস সাদা-কালোতেই প্রকাশিত হয়েছে, দু-রঙের কমিকস দু-রঙেই। প্রসঙ্গত, বাঁটুলের কমিকস চিরকাল নারায়ণবাবু দু-রঙে এঁকেছেন। এক বারই সম্পূর্ণ রঙিন বাঁটুল কমিকস আঁকেন দেব সাহিত্য কুটীরের পূজাবার্ষিকী ‘পূরবী’তে (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। সে রকম আরও অনেক অগ্রন্থিত কমিকস ধারাবাহিকতায় ধরে রাখছে এই সমগ্র। কম্পিউটারে রঙ করার যে প্রচলন হচ্ছে ইদানিং, সেই অনুপ্রবেশ সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন সম্পাদকদ্বয়। পত্রিকাকেই সংগ্রহের মূল ভিত্তি করার ফলে অগ্রন্থিত, দুষ্প্রাপ্য সেই ‘চিত্রে দুর্গেশনন্দিনী’ও পাওয়া যাচ্ছে সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডে। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসকে চিত্রকাহিনির রূপ দিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ, সে কাজ এখন বিস্মৃতির গর্ভে। একটি যথার্থ পূর্বাপর বোধ হয় এ ভাবেই তিল তিল করে গড়ে ওঠে।
এ সমগ্রে একই চরিত্রের কমিকসগুলি সাজানো হয়েছে কালানুক্রমে। প্রতিটি কমিকসের ইতিহাস, প্রথম প্রকাশের সাল-তারিখ, কেন্দ্রীয় চরিত্রটির চেহারার সচিত্র বিবর্তন সব ধরনের তথ্যানুষঙ্গ এ বইয়ে আছে। কালানুক্রমিকতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কমিকসগুলি যে সব পত্রিকায় বেরিয়েছিল তার সবকটির ধারাবাহিক সংগ্রহ না থাকলে এ কাজটা করা সম্ভব নয়। এ সমগ্রের এক সম্পাদক শান্তনু ঘোষ নারায়ণ দেবনাথের সমগ্র সৃষ্টির এক নিষ্ঠ সংগ্রাহকও। তাঁর সংগ্রহ থেকেই কাজটি সম্ভব হয়েছে। সম্পাদকীয় সংযোজন হিসেবে আছে তাঁর লেখা কমিকসগুলির পরিচয় এবং নারায়ণের জীবনপঞ্জি। আর এক সম্পাদক দেবাশীষ দেব সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় বাংলা কমিকসের ইতিহাসে নারায়ণ দেবনাথের অবস্থানটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কাছে আরও সবিস্তার, আরও গভীর বিশ্লেষণ প্রত্যাশিত ছিল। পরের সংস্করণে পরিসর বাধা হবে না আশা করি।
এই যে ‘বাংলা কমিকসের ইতিহাসে’ কথাটা বলতে হল তার নেপথ্যে আছে আমাদের এক ব্যর্থতার ইতিহাস। টিনটিন থেকে অ্যাসটেরিক্স ইংরেজি তো বটেই, বিশ্বের নানা ভাষার সঙ্গে অনূদিত হয়েছে বাংলাতেও। বাঁটুল কিংবা হাঁদাভোঁদার মতো চরিত্রকে কিন্তু ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে পারিনি আমরা, পঞ্চাশ বছরেও। অতি সম্প্রতি অবশ্য সে চেষ্টাটা শুরু করেছে ‘বী বুকস’, ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে নন্টে আর ফন্টে।
দেব সাহিত্য কুটীরের বাঁটুল সমগ্র ও হাঁদাভোঁদা সমগ্র কমিকসের পৃথক বইগুলির একত্র-বাঁধানো সংস্করণমাত্র। এবং, প্রকাশকের কথাতেই, ‘বহুবর্ণে রঞ্জিত’। কালানুক্রম তো দূরের কথা, ন্যূনতম প্রকাশতথ্যটুকুও নেই এই দুই সমগ্রে। প্রকাশক লিখেছেন, ‘প্রথম বাংলা কমিকস চরিত্র ভোঁদা আত্মপ্রকাশ করল শুকতারার ফাল্গুন ১৩৫৮ সংখ্যা থেকে, নাম হল ভোঁদার ভোজবাজী। পরের বছরই এসে গেল দ্বিতীয় চরিত্র হাঁদা, প্রথম কমিকসের নাম হাঁদার এক্সপেরিমেন্ট। সেই বছরই এই মানিকজোড় একসঙ্গে হল, তাদের দু’জনকে নিয়ে প্রথম কমিকস হাঁদা-ভোঁদার ক্রিকেট খেলা। কমিকসগুলি অবশ্য নারায়ণ দেবনাথের নামে প্রকাশিত হত না, প্রকাশিত হত ‘বোলতা’ এই ছদ্মনামে।’ সেই প্রথম হাঁদাভোঁদার টিকিটিও অবশ্য মিলবে না এই ‘সমগ্র’-এ। তা ছাড়া, লালমাটির সমগ্রের ‘গ্রন্থ-প্রসঙ্গ’ অংশ নারায়ণ দেবনাথের দেওয়া তথ্যের অনুসরণে জানাচ্ছে, ‘বোলতা’ আসলে প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
এমনতর সংশয়তিমিরে আলো পড়া দরকার। আমাদের শৈশব আলো করে ছিল যারা, আলো করে আছে একুশ শতকের শৈশবেরও অনেকটা, তাদের নাড়ি-নক্ষত্রও যেন না হারায় ভুল ইতিহাসের অন্ধকারে। |
|
|
|
|
|