উন্নয়নের দাওয়াইয়ে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল
মানুষই মুখ ফেরাবে, হুঁশিয়ারি মাওবাদীদের
মাজের মূল স্রোতে ফিরে না এসে ‘অসৎ’ ও ‘অন্ধকারের’ রাজনীতি জারি রাখলে মানুষই তাদের প্রত্যাখ্যান করবে বলে মাওবাদীদের হুঁশিয়ারি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রক্তপাত বন্ধ না করলে প্রশাসনিক ভাবে কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি তো আছেই। এর পাশাপাশি মাওবাদীদের ‘গড়’ হিসেবে পরিচিত অযোধ্যা পাহাড় এলাকাকে উন্নয়নের বার্তা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন তাদের জনবিচ্ছিন্ন করারই কৌশল নিলেন।
ঝাড়গ্রামের মমতা মাওবাদীদের জন্য ‘চরমসীমা’ বেঁধে দিয়েছিলেন। বলরামপুরের মমতা জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মাওবাদীদের ‘বিচ্ছিন্ন’ করার প্রয়াস শুরু করলেন। যিনি উন্নয়নের ‘অস্ত্র’ প্রয়োগ করার কথাও জানালেন। আর ‘প্রশাসক’ মমতা বললেন, শান্তির আশায় গত চার মাস তিনি যৌথ বাহিনীর অভিযান বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু মাওবাদীরা তাঁর কথা শোনেনি!
বলে রাখা যাক, শুক্রবারই প্রশাসনিক সূত্রে খবর মিলেছে, একদা পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার মনোজ বর্মাকে অযোধ্যা পাহাড় এলাকায় মাওবাদী-দমনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর যাঁকে এত দিন ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ রাখা হয়েছিল। যে সিদ্ধান্তে প্রশাসনের একাংশ এই বার্তা পড়ছে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সাঁড়াশি আক্রমণে মাওবাদীদের কোণঠাসা করতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বলরামপুরে মাওবাদীদের হাতে নিহত তৃণমূল কর্মী জিতু সিংহের মা’কে সভামঞ্চে ডেকে
সান্ত্বনা দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: অশোক মজুমদার
বলরামপুরের সভায় ‘রাজনীতিক’ মমতা মাওবাদীদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছেন, “আপনারা যে লড়াই করছেন, তাতে কোনও সততা নেই। মানুষকে নিয়ে লড়াই করুন। গণতন্ত্রে মানুষ ছাড়া রাজনীতি হয় না। আপনারা কেন অন্ধকারের জীব হবেন? দিনের আলোয় আসুন। খুনের রাজনীতি আমি করি না। আপনারা ভদ্র ভাবে রাজনীতি করুন। আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ভয়ের রাজনীতি করবেন না।”
আর মনোজ বর্মাকে এখানে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত-নেওয়া ‘প্রশাসনিক’ মমতা বলেছেন, তিনি অযোধ্যা পাহাড়কে ‘লাশের পাহাড়’ হতে দেবেন না।
পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ায় প্রশাসনিক বৈঠকের ফাঁকে বলরামপুরে মমতা আপাদমস্তক ‘রাজনৈতিক সভা’ রেখেছিলেন ইচ্ছে করেই। সেই সিদ্ধান্তও অত্যন্ত চটজলদি নেওয়া। তৃণমূল কর্মী জিতু সিংহকে মাওবাদীরা খুন করার পরপরই।
এই সভা আদতে পরিণত হল তৃণমূলের সাংগঠনিক ‘শক্তি প্রদর্শনে’র সভায়। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘সাংগঠনিক তাগদ’ দেখিয়ে প্রচুর বাস এবং গাড়ি করে মাত্র কয়েক দিনের নোটিসে দলের নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় যে ভিড় জমিয়েছিলেন, তার বেশির ভাগই তরুণ প্রজন্ম। বাকিটার অধিকাংশ জুড়ে মহিলা। যাঁরা আপাতত মমতায় ‘আচ্ছন্ন’।
বলরামপুরের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি তোলার
হুড়োহুড়ি জনতার মধ্যে। শুক্রবার সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি।
পুরুলিয়া সার্কিট হাউসে
মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠক। নিজস্ব চিত্র
সাধারণত ‘সরকারি কর্মসূচিতে’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা নীতিগত ভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য এড়িয়েই চলেন। বলরামপুরের সভায় কিন্তু তিনি মাওবাদীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সরাসরি বিভাজনে মনোনিবেশ করেছেন। জানিয়েছেন, যে গরিব মানুষের উন্নয়নের কথা বলে মাওবাদীরা তাদের আন্দোলন শুরু করেছিল, সেই গরিব মানুষই এখন তাদের আক্রমণের অভিমুখ। মমতার কথায়, সাধারণ গরিব মানুষ এখন মাওবাদীদের ‘শ্রেণিশত্রু’! ভোটের প্রচারে মমতা নিয়মিত বলতেন, ‘মায়েরা দিন উলুধ্বনি, ভাইয়েরা দিন তালি। বাংলা থেকে সিপিএমকে করতে হবে খালি’। এ দিনও সেই একই স্লোগান দিলেন। এ দিনও উলুধ্বনি এবং হাততালির ঝড় উঠল, যখন তিনি সিপিএম ছেঁটে বসিয়ে দিলেন ‘মাওবাদী’ শব্দটা।
‘জননেত্রী’ বললেন, “আপনারাই তো পরিবর্তন এনেছেন। আপনারা সিপিএমকে তাড়াতে পেরেছেন। মাওবাদীদের তাড়াতে পারবেন না? আপনাদের কাছে আমি একটাই জিনিস চাই রুখে দাঁড়ান। মাওবাদীদের সমর্থন করা চলবে না। ভয় পেলে চলবে না।”
বাঁকুড়ার সার্কিট হাউস থেকে প্রশাসনিক বৈঠক থেকে
বেরোনোর সময় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
বাইরে তখন অতন্দ্র
প্রহরা। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ভোটের আগে মমতা গিয়েছিলেন রাজনৈতিক ভাবে সিপিএমকে ‘জনবিচ্ছিন্ন’ করার রাস্তায়। এ দিন সেই একই স্লোগান নিয়ে হাঁটলেন মাওবাদীদের ‘বিচ্ছিন্ন’ করার পথে। মাওবাদীদের চ্যালেঞ্জ করে তাঁর বক্তব্য, “সৎ পথে ফিরে এসো। যা চাও, সব দেব। নইলে মানুষ তোমাদের তাড়া করে বেড়াবে। কোথাও আশ্রয় পাবে না!” জানালেন, মানুষ আর ‘খুনের রাজনীতির’ সামনে ‘বসে বসে আঙুল চুষবে না’। কয়েকটা লোক তাঁদের জেলাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, এই পরিস্থিতি জনতা যেন সহ্য না করেন! বরং তাঁরা যেন পাড়ায়-পাড়ায় টিম করে পাহারা দেন। শান্তি কমিটি গড়েন। যাঁরা বন্দুকের লড়াই না-করে বন্দুক গুটিয়ে দেবেন।
কখনও টেনে আনলেন ভোট-প্রচারের ঢংয়ে ছাত্র-যুব, মা-বোনেদের। কখনও বললেন, উন্নয়নের কাজে বাধা দিচ্ছে মাওবাদীরা। কখনও হাতের মুদ্রায় ভিড়কে অভয় দিয়ে বললেন, “ভয় পাবেন না। জোট বাঁধুন। তৈরি হোন। শান্তি আনুন। শান্তি না-এলে উন্নয়ন হয় না।”
অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে বলরামপুর পুরুলিয়া জেলায় মাওবাদীদের ‘ধাত্রীগৃহ’। এখানকার ঘাটবেড়া কেরোয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই ‘আদিবাসী-মূলবাসী কমিটি’ গড়ে অভিযান শুরু করেছিল মাওবাদীরা। সম্প্রতি মাওবাদী স্কোয়াডের যে দম্পতি দুর্যোধন এবং আকরি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন, তাঁদের মধ্যে আকরির বাড়িও ঘাটবেড়ায়। যিনি ফরওয়ার্ড ব্লকের সাত জন কর্মীকে খুনের ঘটনায় জড়িত ছিলেন। পুরুলিয়ার
বলরামপুর তাই প্রশাসনের খাতায় মাওবাদীদের ‘হট বেড’ বলে নথিভুক্ত।
মুখ্যমন্ত্রীর সভার পথে। বলরামপুরে। ছবি: সুজিত মাহাতো
অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে মাওবাদীরা যে ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করেছে, তার ‘গর্ভগৃহ’ও এই বলরামপুর। এই এলাকা থেকেই পরিকল্পনা করে গত চার বছরে পুরুলিয়া জেলায় বাম-অবাম শিবির মিলিয়ে প্রায় ৪২ জনকে খুন করেছে মাওবাদীরা। যাঁদের শেষতম জিতু সিংহ। এ দিনের সভায় যাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন মমতা।
অকৃতদার জিতু সিংহের বৃদ্ধা এবং প্রায় অশক্ত মা কুলদা সিংহকে বলরামপুর কলেজ মাঠের বিশাল সমাবেশের সামনে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে মমতা জনতাকে প্রশ্ন করেছেন, “এঁকে দেখে কি শ্রেণিশত্রু মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে ইনি খুব ধনী? এই মা’কে দেখে কি মনে হয়, ইনি খুব বড়লোক?”
জনতা গর্জন করেছে, “না! না!”
দৃশ্যতই দীনহীন চেহারার কুলদাদেবীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মাওবাদীদের উদ্দেশে মমতা বলেছেন, “গরিব মানুষ তা হলে এখন আপনাদের শ্রেণিশত্রু কমরেড? আর বড়লোকেরা আপনাদের বন্ধু? আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই, কোন ইজ্ম এ ভাবে গরিব মানুষকে খুন করতে শেখায়!”
সেখান থেকেই শুরু হল মাওবাদীদের প্রতি মমতার ‘রাজনৈতিক আক্রমণ’। যে আক্রমণ বলল, “এরা নাকি গরিবের জন্য লড়ে! গরিব মানুষের জন্য লড়াই তো করতেন আমার জিতু সিংহ! তাঁকে খুন করে কোন গরিব মানুষের ভাল করছ তোমরা? তোমরা গরিব মানুষকে খুন করতে উস্কানি দিচ্ছ। এখনও সময় আছে, মূলস্রোতে ফিরে এসো। শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যা চাইবে দেব। কিন্তু বন্দুক ধরলে, দুঃখিত, আমি অযোধ্যা পাহাড়কে আর রক্তাক্ত হতে দেব না!”
বলেছেন, অযোধ্যা পাহাড়কে ঘিরে তিনি পর্যটনের বিস্তার করবেন। পর্যটনের বিকাশের জন্য গড়বেন এমনকী বিমানবন্দরও! এই মমতা ‘প্রশাসক’। যিনি উন্নয়নের ‘অস্ত্র’ প্রয়োগ করতে চান মাওবাদী-দমনে।
মাওবাদীদের ‘আদিবাসী-মূলবাসী কমিটি’ গড়েছিলেন অঘোর হেমব্রম। এখন তিনি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়েছেন ‘জঙ্গলমহল উন্নয়ন-বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি’। যারা সরাসরি মাওবাদীদের সঙ্গে টক্কর নিচ্ছে। মাওবাদীদের খতম-তালিকায় নাম উঠে গিয়েছে অঘোরের।
সেই অঘোরকে জনতার সামনে পেশ করে মমতা বলেছেন, “আপনারা অঘোরকে খুন করবেন? কাকে কাকে খুন করবেন কমরেড? লিস্ট বানিয়েছেন? আমি জানি, এখনও আপনারা লুকিয়ে আমার কথা শুনছেন। কারণ সামনে এসে কথা বলার বা শোনার সাহস আপনাদের নেই! কিন্তু মনে রাখবেন, এক জন অঘোর খুন হলে লক্ষ অঘোর উঠে দাঁড়াবে!”
এ সবই, রাজ্য-রাজনীতির কারবারিরা জানেন, ‘রাজনীতিক’ মমতার ‘ইউনিক সেলিং পয়েন্ট’। যে রাস্তায় হেঁটে তিনি রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এনেছেন। দেখার, তিন মাস পর যখন তিনি আবার আসবেন পরিস্থিতি পর্যালোচনায়, তখন মাওবাদী-মোকাবিলায় পুরুলিয়ায় কে ফেরেন ‘রাজনীতিক’ না ‘প্রশাসক’।

ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
পুরুলিয়া বাঁকুড়া
• পুরুলিয়া শহরের অদূরে ছড়রায়
পরিত্যক্ত বিমানবন্দর পুননির্মাণ
• অযোধ্যা পাহাড়, জয়চণ্ডী পাহাড়
ও পঞ্চকোট পাহাড়কে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র
• ২০টি মডেল স্কুল
• ৮টি ছাত্রী-আবাস
• জেলায় সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিভাগ
• প্রতিটি ব্লকে হিমঘর
• বাঘমুণ্ডিতে পলিটেকনিক কলেজ
• ৩২৬টি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ
• ৮টি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা পরিষেবা ইউনিট
• খেলার উন্নতিতে জেলায় স্পোর্টস অ্যাকাডেমি
• ঝালদায় বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
• বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘মা ও নবজাতক পরিচর্যা’ কেন্দ্র তৈরি
• চারটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা পরিষেবা ইউনিট
• ৩৫৬টি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ
• ৯টি ছাত্রী-আবাস
• ৮টি মডেল স্কুল
• ৪১টি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল
• ৭৮টি নতুন প্রাথমিক স্কুল
• বিষ্ণুপুর, শুশুনিয়া, জয়রামবাটীকে
ঘিরে পর্যটন শিল্পের বিকাশ।
• মুখ্যমন্ত্রী জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পলিটেকনিক কলেজ এবং আইটিআই স্থাপনের প্রস্তাব চেয়েছেন। পূর্ত দফতরের অফিসারদের কাছে জানতে চান, কোথায় নতুন রাস্তা করতে হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.