চাষে ‘হোঁচট’ খেয়ে রাসে নেই ‘তাঁরা’
কটা সরু কঞ্চি হাত দুয়েক লম্বা মাথায় জড়ানো এক ফালি লাল বা হলুদ অথবা গোলাপি রঙের তেকোণা রেশমি কাপড়ের টুকরো। এ’টা নিশান আর এই নিশান হাতে চল্লিশ পঞ্চাশ জনের একটা সারবদ্ধ দলের সামনে এক জন শক্তপোক্ত মানুষ। গামছা অথবা মাফলার জড়ানো ওই নিশান দুলিয়ে গোটা দলটিকে থিকথিকে ভিড়ে নিশান নাড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন যিনি।
মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম অথবা বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রতি বছর এ ভাবেই দল বেঁধে হাজার হাজার মানুষ আসেন নবদ্বীপের রাস কিংবা শান্তিপুরের ভাঙা রাসের মেলা দেখতে। এ বার তাঁরা কোথায়?
প্রান্তিক কৃষক অথবা ক্ষেতমজুর, বর্ষা শেষে ফসল বিক্রি করা টাকা হাতে বেরিয়ে পড়েন মেলা দেখতে। অথচ এ বারের রাসে তাঁরা ভীষণভাবে অনুপস্থিত। রাসের আগের দিন বা রাসের দিন শহরের মঠ-মন্দিরের চাতাল, রেল স্টেশন বা পুরসভার তৈরি অস্থায়ী যাত্রী নিবাস এই সব মানুষের রাত কাটানোর ঠিকানা। সেখানেই চালে ডালে দুটো ফুটিয়ে নেওয়া মাথায় বোঁচকা, একে অপরের শাড়ির আঁচল বা চাদরে গিঁট বেঁধে রাখা, যাতে দল ছুট না হয়ে পড়েন। তারপর শুধু হাঁটা আর দেখার পালা।
নিজস্ব চিত্র।
কেন এ বার আসেননি ওই মানুষগুলো? উত্তরটা দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুরের সত্যবান গিরি। জনা পঞ্চাশের দল নিয়ে সত্যবানবাবু তবুও এসেছেন রাস দেখতে। তিনি বলেন,‘‘ যাঁরা এ ভাবে আসেন তাঁরা বেশিরভাগই চাষ আবাদের সঙ্গে যুক্ত। এখন তো ভরা মরসুম আমন ধান কাটা হচ্ছে রবিশস্যের চাষও শুরু হয়ে গিয়েছে। সুতরাং চাষির হাতে আনন্দ করার সময় নেই। বরং এ বারের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি বা পাটের দাম না পাওয়ায় যা লোকসান হয়েছে এখন সেই ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে নিচ্ছে চাষিরা। তাই চাষিদের এখন মাঠ ছাড়ার জো নেই।’’ তাহলে আপনি যে পঞ্চাশ জনকে নিয়ে এসেছেন? উত্তরে সত্যবানবাবু বলেন,‘‘ আরে এরা তো সব বুড়ো বুড়ি চাষের মাঠে এদের কোন কাজ নেই।’’
চাষির হাতে পয়সা না থাকা এবং আমন ও রবি মরসুম শুরু হয়ে যাওয়ায় রাস দেখতে গ্রামীণ মানুষের ভিড়টা যে একেবারেই নেই তা স্বীকার করেছেন সবাই। এলাকার এক সম্পন্ন কৃষক বাসুদেব চৌধুরী বলেন,‘‘ এ বারে আমন ধান কাটার মজুরি গতবারের তুলনায় দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে ফলে চাষিরা নাওয়া খাওয়া ভুলে মাঠে ব্যস্ত তাদের সময় নেই উৎসব দেখার। গত বছরে এই আমন মরসুমে ধান কাটার মজুরি ছিল ৭০ টাকা আর দু কেজি করে চাল প্রতি দিন এ বারে সেই মজুরি বেড়ে হয়েছে ১৩০ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষেতের কাজ সেরে কেউ মেলা খেলা দেখতে আসছেন না।’’
গত বর্ষায় বন্যা, অতি-বর্ষনে চাষের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার এটাই উপযুক্ত সময় এ কথা বলছেন কৃষি দফতরের কর্তারাও। বর্ধমানের পূর্বস্থলীর সহকারী কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন,‘‘ধানের বাজার দর খুব খারাপ গত বছরে বস্তাপিছু ধানের দর ছিল ৬০০ টাকার উপর। এ বার তা নেমে ৪৫০ টাকা হয়েছে পাটে চাষিরা এ বার পয়সা পাননি প্রবল বর্ষনে শাকসব্জি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ সবদিকেই চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত মরসুমে সেই ক্ষতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে এখন বরং সব্জির দর চড়া ফলে সব্জি চাষিও যেমন উপকৃত হচ্ছেন তেমনি ধান কাটার মজুরি বাড়ায় ক্ষেতমজুরেরাও লাভবান হচ্ছেন। সেই কারণেই চাষি এখন উৎসব অনুষ্ঠানে তেমনভাবে আসছেন না।’’
নদিয়া মুর্শিদাবাদের যুগ্ম কৃষি অধিকর্তা হরেন্দ্র কুমার ঘোষ বলেন,‘‘এ বার যা অবস্থা তাতে এখন যেখানে যত উসব হবে কিছুতেই চাষিরা অংশগ্রহন করবেন, না এই রাজ্যে চাষিদের সবথেকে বড় আর্থিক সহায়তা দেয় পাট সেই পাটেই চাষিরা উপযুক্ত সহায়ক মূল্য না পাওয়ায় নিদারুন আর্থিক ক্ষতির সামনে পড়েছেন সেই ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ রবিচাষ ও মরসুমি অন্যান্য চাষ আবাদ চাষিরা সেটাই করছেন শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতে অতিবর্ষন আর বন্যা মিলিয়ে প্রায় ৯৩ কোটি টাকার ফসল ক্ষতি হয়েছে এই অবস্থায় চাষি বা ক্ষেতমজুরকে আনন্দ উসবে দেখতে না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।’’
পাশাপাশি বদলে যাওয়া শিক্ষা মরসুমও এ বারের রাস-সহ অন্যান্য স্থানীয় উৎসবে মানুষের অংশগ্রহন কিছুটা পরিমাণে কমিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু হচ্ছে জানুয়ারিতে। ফলে সমস্ত স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের টেষ্ট। সব মিলিয়ে যে সব বাড়িতে স্কুলপড়ুয়া এবং টেষ্ট পরীক্ষার্থী রয়েছে তাঁরা সেভাবে স্থানীয় উৎসবে মেতে উঠতে পারছেন না।’’ রাস তার আপন বেগেই শেষ হচ্ছে। কিন্তু উৎসব সরণীতে এ বার সামিল হতে পারলেন না পাঁচমুড়া, গোপীবল্লভপুর কিংবা বাঘমুন্ডির সেইসব মাটির মানুষেরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.