|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি ১... |
|
নিজের মতো করে সাফল্যের সংজ্ঞা ঠিক করে নিয়েছি |
মুম্বই থেকে এখনও প্রচুর টাকার কাজের অফার। টালিগঞ্জেও ব্যস্ত সিডিউল। গত চার বছরের পেশাদারি ক্লান্তি
আর ব্যক্তিগত টানাপোড়েন তা হলে ইতিহাস? জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার মুখে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।
এত দিন পর অকপট। একমাত্র পত্রিকার পাতায়। সামনে দেবশ্রুতি রায়চৌধুরী |
পত্রিকা: এক সহকর্মীর কাছে শুনলাম, সম্প্রতি একটা অনুষ্ঠানে ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে’ গানটা গেয়েছেন। এক বছর আগে পত্রিকা-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “যে দিন আবার এই গানটা গাইতে পারব সে দিন বুঝব আমি ভাল হয়ে গেছি”...
রূপা: হ্যা। এই গানটা গাইতে আর কষ্ট হয় না।
পত্রিকা: আরও আছে। গত বেশ কিছু মাস ব্ল্যাকবেরি ম্যাসেঞ্জারে আপনার স্টেটাস ছিল ‘আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’...
রূপা: ঠিকই। গানের এই লাইনটাই গত বছর মুম্বইয়ে সাহায্য করেছে আমায় নিজের মতো করে বাঁচতে।
পত্রিকা: সেই বাঁচাটা কেমন? জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না পেরে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া?
রূপা: বাজে কথা। আপনি আমার যে প্রচন্ড ইমোশনাল দিকটার কথা বলছেন এ ক্ষেত্রে সেটার ভূমিকা সামান্য। মুম্বইয়ে গত চার বছর ধরে পাগলের মতো পরিশ্রম করেছি, দম ফেলার ফুরসত পাইনি। খুব মনে হচ্ছিল অনেক হল। এ বার নিজেকে এমন করে গোছাতে হবে যেখানে রাতে বাড়ি ফিরে গান শুনতে শুনতে ঘুমোতে যেতে পারব। এক পাতা হলেও নিজের পছন্দের বই পড়তে পারব। তার পর দুম করে কোনও বন্ধু ফোন করে “এই আমরা আড্ডা মারছি। তুই চলে আয়” বললে লাফাতে লাফাতে রওনা হব। পরের দিন নিয়মমাফিক সকালে কাজে দৌড়বার টেনশনটা থাকবে না। পৃথিবীতে নিজেকে, নিজের দায়িত্ববোধকে ছাড়া আর কাউকে জবাব দিতে হবে না। এটাই এখন আমার কাছে নিজের মতো করে বাঁচা। যা এতদিনে করতে পেরেছি। সঙ্গে প্রচুর পছন্দের কাজ। ভাল আছি।
|
|
পরের ছবি ‘অন্তর’-এ জেলারের ভূমিকায় |
পত্রিকা: কিন্তু ফিরে এসে কী কাজ করছেন সেটা জানার সুযোগও তো মিডিয়াকে দেন না! আপনাকে উন্নাসিক ভাবা হয় জানেন তো?
রূপা: কিছু করার নেই। ভাল লাগে না বেশি বকবক করতে। “মাই ওয়ার্ক শুড স্পিক ফর মি”। তা ছাড়া কোনও দিনও মনে হয়নি এমন কিছু কাজ করেছি যা নিয়ে প্রচুর কথা বলতে হবে। উল্টে সব সময় মনে হয়েছে যে ধুর! কিছুই তো পারলাম না। এই যেমন “২২শে শ্রাবণ”-এ বুম্বার কাজ দেখে মনে হল আমি যদি এর কণা মাত্রও পারতাম! আবার একটা অনুপ্রেরণাও পেলাম এই ভেবে যে, বুম্বা যে ভাবে নিজেকে ক্রমাগত গড়ে চলেছে আমিও তো পারি সেই চেষ্টাটা করতে।
পত্রিকা: তা হলে উন্নাসিকতা নয়? নিজেকে নিয়ে কমপ্লেক্স?
রূপা: আপনার যা মনে হয় ভাবতে পারেন। সোজা উত্তরটা হল, নিজেকে জাহির করতে পারি না। ধাতে নেই। আজকাল এমন অনেক কিছুই হয় যেটা আমি পারি না। যেমন, এখনও শু্যটে থাকলে আমার মোবাইল সাইলেন্ট থাকে। তবে একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলি, যখন মুম্বই ছেড়ে কলকাতা আসার কথা ভাবিওনি, তখন অদিতি রায় আর নীল মিত্র তাঁদের ‘অবশেষে’ ছবিটার জন্য আমাকে সাইন করাতে যে ভাবে দেড় বছর ধরে অপেক্ষা করেছিলেন তাতে মনে হয়েছিল কোথাও একটা ভাল কাজের, ভাল কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের মর্যাদা আছে। তারপর কলকাতায় আস্তে আস্তে যখন ইন্ডাস্ট্রির বন্ধুরা বুঝতে পারল যে আমি এখন কলকাতাতেই থাকব, মুম্বই পালাব না, তখন এত ভালবেসে নানা চরিত্রে ডাকতে শুরু করল যে, আমার মনে যে সামান্যতম ভয়টুকু ছিল...
পত্রিকা: কীসের ভয়? চার বছর বাদে ফিরে এলে কাজ পাওয়া সহজ না? সিরিয়ালে কাজ করেছেন এই ক’টা বছর। বড় পর্দায় ফেরা মুশকিল?
রূপা: ভয়গুলো অমূলক? সিরিয়ালের অভিনয়ের ধাঁচ আর বড় পর্দায় অভিনয়ের ধাঁচ সম্পূর্ণ আলাদা। এত দিন টালিগঞ্জ ছাড়া। ভেবেছিলাম লোকে তো ভুলেই গেছে যে রূপা কী কাজ করেছে। তবে এখন পরম-রুদ্রর প্রোডাকশনে কাজ করছি। অশোক বিশ্বনাথনের ‘শান্তিনিকেতন’ শু্যট চলছে। সঙ্গে অনুরাগের (বসু) ‘বরফি’। তা ছাড়া, সৃজিতের পরের দু’টো। অঞ্জনের (দত্ত) পরের ছবি। অরিন্দম শীলের দু’টো। রিঙ্গোর ছবিটা। সিনেমাটোগ্রাফার প্রেমেন্দুবিকাশ চাকির ছবি। সব মিলিয়ে পরের বছর জুন-জুলাই অবধি চলবে। এত বিভিন্ন ধরনের চরিত্র এক সঙ্গে আগে কখনও পাইনি। আসলে এমন একটা বয়সে পৌঁছে গেছি যে পরিচালকেরা আমাকে বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে ভেবে এক্সপেরিমেন্ট করতে সাহস পাচ্ছেন। আর কোথাও আমার কাজের ওপর ভরসাটা সবার অটুট আছে ভেবে নিজেকে খুব ফরচুনেট মনে হচ্ছে।
পত্রিকা: মুম্বই আর ডাকছে না?
রূপা: ১৯৯১-এ মুম্বই ছেড়ে এসেছি স্বেচ্ছায়। জোর-জবরদস্তি এড়াতে না পেরে ফেরত গেছি ওদের ডাকে ’৯৫-এ। এক বছর কাজ করে আবার ফিরেছি ঘরে। সংসারে। সত্যিটা হল এই যে ২০০৭-এ হ্যাঁ করেছিলাম বারবার ওদের হতাশ করব না বলে। এ বার আবার ফিরলাম। মাসে ২৫ দিনের প্রচুর টাকার কাজ এ রকম অন্তত ১৫টা দামি চ্যানেলের দামি সিরিয়াল ফিরিয়ে দিয়ে বসে আছি ২০১১-র মার্চ থেকে। ওদের বলেছি, জুনের পর যোগাযোগ করতে। তত দিনে যদি কলকাতা আমায় নতুন কাজ আর না দেয়, ফিরে যাব।
পত্রিকা: পুরনো কথায় ফিরি। বলতে চাইছেন, শুধুই কাজের ক্লান্তির পর কলকাতায় ফিরে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া পর্ব? গত এক বছরে আপনার ব্যক্তিগত জীবনে যে ঝড় বয়ে গেছে তার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই?
রূপা: তা কেন? ব্যক্তিগত জীবনের ক্লান্তি, প্রফেশনাল লাইফে চূড়ান্ত পরিশ্রমের ক্লান্তি সব কিছুর সঙ্গেই এর যোগ আছে। কলকাতায় ফিরে তিন মাস কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করিনি প্রায়। ঘুমিয়েছি শুধু। নিজেকে গুছিয়ে নেওয়াটা শুরু করতে।
পত্রিকা: এই গুছিয়ে নেওয়া থেকে কী শিখলেন? ইমোশন, সম্পর্ক এ গুলোর থেকে কাজ নিয়ে বেঁচে থাকা জরুরি?
রূপা: যে জিনিসটা সব থেকে বেশি শিখলাম সেটা হল এত কিছুর পরেও মানুষ হিসেবে আমি যা আমি সেটাই থেকে যাব। নিজেকে পাল্টানো আমার দ্বারা হবে না। জন্ম থেকেই আমি চূড়ান্ত ইমোশনাল। শর্ট টেম্পারড, কাজ পাগল, ছটফটে এ রকমই থাকব। যেমন মুখের ওপর সত্যি কথা বলে দিই তেমনই বলব। আর এই সব কিছু নিয়েই আমি আমার মতো করে ভাল থাকব। কারও সাতে-পাঁচে, একুশে-পঁচিশে আমি নেই বাবা! আর আমার কিচ্ছু যায় আসে না বাইরের পৃথিবী আমায় নিয়ে কী বলল! খুব ফরচুনেট যে খুব ভাল কয়েক জন বন্ধু আছে। যারা সব সময় পাশে থেকেছে...
পত্রিকা: বলছেন কোনও একাকিত্ব নেই আপনার? লোকে তো এটা পড়লে হাসবে...
রূপা: বেশ। তা হলে বলি, এত কিছুর পরেও আমার মধ্যে কোথাও কোনও একাকিত্বের বোধ যদি থেকে থাকে তা হলে সেই একাকিত্বই আমার সব থেকে বড় শক্তি। আমি আমার পাগলুকে নিয়ে (রূপার মাস কয়েকের পাগ) খুব ভাল আছি। আমার একটা অসাধারণ ভাল ছেলে আছে। সে আমাকে এত ভাল বোঝে...
|
|
পত্রিকা: ছেলে, মানে আকাশকে ছেড়েই তো চলে গিয়েছিলেন...
রূপা: মূলত টাকা রোজগার করতে গিয়েছিলাম। আমার মুম্বইয়ের বাড়িতে বড় বড় করে লেখা থাকত ‘অল ফর দ্য মানি’। চার বছরের এই রোজগারটার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আকাশকে ছেড়ে থাকার কষ্টটাও সাংঘাতিক ভাবে তাড়া করে বেড়িয়েছে। আজও যে আমি ওর সঙ্গে সারা ক্ষণ থাকতে পারি তা না। কিন্তু ও জানে ওর মা আছে পাশের গলিতেই। জাস্ট একটা ফোন। এটা আমার কাছে বিশাল পাওয়া।
পত্রিকা: এটাই জীবন? সম্পর্ক না থাকাটা মিস করেন না আর?
রূপা: করি না। যে ভাবে আছি এর থেকে শান্তিতে বহু দিন থাকিনি।
পত্রিকা: এটা তো নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া! ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ। প্রফেশনাল লাইফেও সেই জায়গাটায় পৌঁছতে পারলেন না যেখানে আপনার মতো অভিনেত্রীর পৌঁছনোর কথা ছিল।
রূপা: (একটু উত্তেজিত) কে ঠিক করে দেবে বলুন তো কোনটা ব্যর্থতা আর কোনটা সাফল্য? আপনি? মিডিয়া? আমি আমার মতো করে আমার সাফল্যের সংজ্ঞা ঠিক করে নিয়েছি। সেটা হল, যে কাজটা করছি বা করেছি সেটা মন দিয়ে, সততার সঙ্গে করেছি কি না। সেটা বাড়ির সামান্য কোনও কাজ হতে পারে। বা ফিল্মের কাজ। আপনি যদি বলেন যে রূপা আপনি বাড়িটা ঠিক মতো পরিষ্কার করে রাখেননি বা ওই ছবিটায় আপনার অভিনয়টা বাজে হয়েছিল সেটা শুনতে রাজি আছি। কিন্তু আরও বেশি করে আপনাদের নির্ধারিত সাফল্যের পিছনে দৌড়ইনি বলেই আমি ব্যর্থ এটা মানতে রাজি নই।
পত্রিকা: যে যুগের যা ধমর্। এখন মিডিয়ার সামনে থাকা, পি আর বাড়ানো এগুলো দরকার। এটা মেনে নিতে অসুবিধে কোথায়?
রূপা: অসুবিধে নেই তো। কিন্তু সব কিছু সবার ক্ষেত্রে সত্যি হতে হবে এমন কোনও নিয়ম আছে? আমি আমার শোওয়ার ঘরে, ঠাকুরঘরে মিডিয়াকে ডেকে আনি না। জীবনের সব খুঁটিনাটির খবর মিডিয়াকে জানিয়ে ছবি ছাপাই না। যখন তখন তাদের ফোন ধরি না। তার মানেই আমি ব্যর্থ?
পত্রিকা: সৃজিতের ছবিতে স্বস্তিকার সঙ্গে কাজ। রিঙ্গোর ছবিতে দিব্যেন্দুর সঙ্গে। স্বচ্ছন্দ?
রূপা: ওরা আমার কো-স্টার। স্বচ্ছন্দ বোধ করব না কেন? আমার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির কারও কখনও ঝামেলা ছিল না। এখনও নেই।
পত্রিকা: আপনি জানেন প্রশ্নটা কেন করেছি। সোজা উত্তর আশা করা যায়?
রূপা: দেখুন দিব্যেন্দুর সঙ্গে ঘটনাটার পর একটা অনুষ্ঠানে স্বস্তিকার সঙ্গে নিজেই গিয়ে কথা বলেছিলাম। দিব্যেন্দু যখন বহু দিন বাদে ফোন করে কথা বলতে চেয়েছিল খুব সহজ ভাবে বন্ধুর মতো কথা বলেছি। এখনও এখানে ওখানে দেখা হয়ে গেলে সহজ থাকারই চেষ্টা করি। আর একটা জিনিস বুঝে গেছি। কোনও কিছু মনে পুষে রাখা মানে ওয়েস্টেজ অফ টাইম অ্যান্ড ইমোশন। জীবন সবাইকে সব কিছু ফেরত দেয়। দেবেই। আমি এখন ৪৫। আমার বয়সে সবাই একদিন পৌঁছবে। জীবনের নিয়মই তাই। একটা ছোট্ট মেয়ে তো বলতেই পারে, “কে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়? আমি চিনি না।” তাতে আমার অস্তিত্ব ধূলিসাৎ হয়ে যায় না। কলকাতার বাড়ির দেওয়ালে পোস্ট ইট লাগানো আছে। “ডু নট লেট পিপ্ল ইউজ ইউ, রূপা। লাইফ উইদাউট রেসপেক্ট ইজ আ বিগ জিরো।” জীবনে অনেক পেয়েছি। কী কী পাইনি তার হিসেব মেলাতে বসতে আর রাজি নই।
পত্রিকা: শেষ প্রশ্ন। তিনটে নাম বলব। বাক্য রচনা করুন। সৃজিত। স্বস্তিকা। দিব্যেন্দু।
রূপা: বাহ্ ভাল প্রশ্ন করলেন তো! (একটু ভেবে) সৃজিত, আমার ভীষণ ভাল বন্ধু। গুণী পরিচালক। বাংলা ছবিকে ‘২২শে শ্রাবণ’-এর মতো আরও অনেক ছবি উপহার দিক।
দিব্যেন্দু অসামান্য গায়ক।
স্বস্তিকা ভারী মিষ্টি দেখতে। সুঅভিনেত্রী।
একটা মজার মিল আছে এই তিনটে মানুষের মধ্যে। এরা তিন জনই নিজেদের অজান্তে মানুষ রূপাকে অন্য ভাবে জাগিয়ে তুলেছে। আমি ওদের কাছে ঋণী। |
|
|
|
|
|