অতঃপর আদালত গৃহপানে চলিবে। সাধারণত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ নানাবিধ বিবাদের জন্য বিভিন্ন সময় জনতা আদালতের শরণার্থী হইয়া থাকেন। কেন্দ্রীয় সরকার স্থির করিয়াছে, আদালতেরই জনতার নিকটে পৌঁছাইবার সময় হইয়াছে। সমস্ত বিবাদ এমন নহে যে তাহার জন্য উচ্চতর আদালতের মীমাংসা প্রয়োজন। কাহার ধান কে কাটিয়াছে, বিবদমান ভাড়াটিয়া না গৃহ-মালিক, কে প্রকৃত দোষী, এই ধরনের প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের নিকট গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই বিবাদের জন্য বৃহত্তর বিচারপ্রাঙ্গণে যাইবার কোনও প্রয়োজন হয় না। অথচ, এই জাতীয় বিবাদ ঘটিতেই থাকে। নিত্যদিন। ভবিষ্যতেও যে সেই স্রোতে ভাটা পড়িবে, এমন সম্ভাবনা নাই। সুতরাং, ছোটখাটো বিবাদের আইনি নিষ্পত্তি যদি স্থানীয় স্তরে কোনও নিম্ন আদালতে হয়, তাহা মামলার ভারে ন্যুব্জ বিচারব্যবস্থার স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভাল। ইহাই ‘গ্রাম ন্যায়ালয়’ গঠনের মৌলিক সূত্র। বন্দোবস্তটি সাধু। ভারতে বিচারপ্রক্রিয়া বিপুল মাত্রায় কেন্দ্রীকৃত। ফলে, যে কোনও বিবাদের জন্যই দূরান্তরে গিয়া আপিল করিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই সংকট আরও বেশি, কারণ ইহা কার্যত একটিমাত্র মহানগর-কেন্দ্রিক রাজ্য। যাহাই ঘটুক, আইনি মীমাংসার উচ্চতর স্তরে কিছু করিতে হইলে কলিকাতা ভিন্ন গতি নাই। তাহার পর মামলা শুরু। কালহরণেরও সূচনা। শেষ পর্যন্ত গঠিত হইলে ‘গ্রাম ন্যায়ালয়’ এই বদ্ধ পরিবেশে মুক্তির সূচনা করিতে পারে।
শুধুমাত্র আরও কিছু আদালত গড়িয়া দিলেই কিন্তু সংকট মিটিবে না। কারণ, ভারতে বিচার ব্যবস্থার কার্যপদ্ধতির ভিতরেই কিছু সংকট রহিয়া গিয়াছে। যেমন, আদালতে মামলার সংখ্যা অত্যধিক। তাহার অনেক মামলাই আদালতের গ্রহণ না করাই বিধেয়। যথা, ‘জনস্বার্থ’র দোহাই দিয়া এখনও আদালতে বহু মামলা নথিভুক্ত করা হয়। ভারত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। সেই দেশে জনস্বার্থ রক্ষার জন্য, তাহা কোনও ভাবে ব্যাহত হইতেছে কি না, তাহা খেয়াল রাখিবার জন্য রীতিমতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন। স্থানীয় হইতে সংসদীয় স্তর পর্যন্ত আছেন। জনস্বার্থের বিষয়টি তাঁহাদেরই উপর ছাড়িয়া দিলে কোনও অসুবিধা নাই। জনস্বার্থের রক্ষণাবেক্ষণই তাঁহাদের কর্তব্য। সুতরাং, আদালতকে কেন ইহার সহিত জড়াইতে হইবে, তাহা বুঝা কঠিন। একই ভাবে, যে প্রক্রিয়ায় এই দেশে মামলা চলে, তাহা কেন এমন দীর্ঘসূত্রী হইবে, তাহাও বিবেচনার বিষয়। এমন অজস্র মামলা থাকে, যাহার নিষ্পত্তি খুবই স্বল্প সময়ের ভিতরেই হইবার কথা। প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেশ করা হইবে, দুই তরফের আইনজীবীগণ যে যাহার বক্তব্য রাখিবেন। বিচারক রায় শুনাইবেন। অথচ, তাহা হয় না। আইনজীবীগণ বিভিন্ন অজুহাতে অকারণ সময় ব্যয় করেন বলিয়া অভিযোগ। রায় শুনাইবার ক্ষেত্রেও বিলম্ব ঘটে। ফলে, যে মামলাটির, ধরা যাক, কয়েকটি দিনের ভিতরেই মিটিয়া যাইবার কথা, তাহা বৎসরের পর বৎসর চলিতে থাকে। জমিয়া থাকা মামলার পাহাড় বিচারব্যবস্থার গলায় ফাঁসের ন্যায় আঁটিয়া বসে। সময়ের এমন বিচিত্র অপব্যয় বিচারপ্রক্রিয়ার ভিতরেই নিহিত। ইহারও সংস্কারসাধন জরুরি। অন্যথায় বিচারপ্রক্রিয়াকে যথার্থ অর্থে ত্বরান্বিত করা যাইবে না। প্রক্রিয়ার নিহিত সমস্যাগুলি লইয়াও বিবেচনা প্রয়োজন। অবিলম্বে। |