|
|
|
|
দল-সরকার আলাদা, রেখা টানতে চান কারাট |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘অসম্পূর্ণ’ কাজ সম্পূর্ণ করতে চাইছেন প্রকাশ কারাট।
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বামফ্রন্ট সরকারকে সিপিএমের ‘নিয়ন্ত্রণমুক্ত’ করার চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের শিকল ভাঙতে পারেননি তিনি। এ বার মতাদর্শগত দলিলে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ‘বিভাজন’কে ‘পাকাপোক্ত রূপ’ দিতে চাইছেন
কারাট। তিনি মনে করছেন, সোভিয়েতে এই ভুল
হয়েছিল। চিনও একই ভুল করছে। সেই ভুল হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। গত বিধানসভা নির্বাচনে যার মাশুল গুণতে হয়েছে।
আলিমুদ্দিন বা এ কে জি ভবন অতীতে সরকারের উপরে ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করেছে, এই অভিযোগ না-মানলেও সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যুক্তি, রাজ্যে দল অনেক ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছে। উদাহরণ, নন্দীগ্রাম। সেখানে পেট্রো-রসায়ন শিল্প তালুকের জন্য প্রশাসন কোনও জমি অধিগ্রহণ করেনি। অথচ স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে বার্তা গিয়েছে, লক্ষণ শেঠের লোকেরা সরকারের হয়ে জমি ‘দখল’ করছে। মাওবাদী দমনের ক্ষেত্রেও একই ‘বাড়াবাড়ি’ হয়েছিল। বলা হয়েছিল, প্রশাসনের যৌথ অভিযানের পাশাপাশি মাওবাদীদের ‘রাজনৈতিক ভাবে’ মোকাবিলা করার দায়িত্ব পালন করবে দল। কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, দলের ক্যাডাররাই বন্দুক হাতে মাওবাদীদের মোকাবিলায় নেমে পড়েছে। নেতাইয়ের ঘটনায় তা প্রকাশ্যে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারের উপরে দলের ‘নিয়ন্ত্রণ’ কায়েমের চেষ্টা বা তাদের ‘অতি-সক্রিয়তা’র দায় নিতে চাননি কারাট। যদিও সিপিএমের একাংশ মনে করে, দলের কাজে যদি কোথাও ‘ভুল’ বা ‘বাড়াবাড়ি’ হয়ে থাকে, সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কারাটের উপরেও তার দায় বর্তায়।
কারাটের নেতৃত্বেই কেন্দ্রীয় স্তর থেকে সিপিএমে প্রয়াস শুরু হয়েছে সরকার ও দলের পৃথক ভূমিকা স্পষ্ট করে দেওয়ার। আজ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে মতাদর্শগত দলিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলিলের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হল, একবিংশ শতাব্দীর পুনরুজ্জীবিত সমাজতন্ত্রের রূপরেখা কী হবে। সেখানে সরকার ও দলের মধ্যে কী ভাবে সুস্পষ্ট বিভাজন থাকবে, তার দিশানির্দেশ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। এক পলিটব্যুরো সদস্যের ব্যাখ্যা, “সরকার গোটা জনসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। দল কোনও ভাবেই বলতে পারে না যে, তারা গোটা জনসমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে। কাজেই দলই যদি সরকার হয়ে উঠতে চায়, তা হলে গোটা জনসমাজের প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব হয় না।”
কারাট শিবির বলছে, পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধবাবু দলের ‘শিকল’ ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তিনিই আবার প্রশাসক হিসেবে ‘আমরা-ওরা’র বিভাজন তৈরি করে দিয়েছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি গোটা জনসমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ মহল আবার বলছে, এ কে জি ভবনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বরাবর রাজ্য সরকারের উপরে লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছেন। প্রয়াত জ্যোতি বসুর আমলে সরকার তাই দলেরই অন্য নাম হয়ে উঠেছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘দলতন্ত্রে’র অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত সর্বত্র দলের লোক বসিয়ে শিক্ষার ‘অনিলায়ন’ ঘটানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে একই ভাবে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের সামনে প্রশাসনকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। ‘রাজধর্মে’র দাবি পূরণ করতে দেয়নি ‘দলতন্ত্র’।
দলের কট্টরপন্থীরা এই অভিযোগ মানছেন। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য, এক বার রেললাইনে গাড়ি চলতে শুরু করলে সেখান থেকে অন্য লাইন ধরা খুব কঠিন। পশ্চিমবঙ্গেও তা-ই হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যে ভাবে কাজ শুরু হয়েছিল, পরে তার ভুলভ্রান্তি ধরা
পড়লেও দল টানা ক্ষমতায় থাকার ফলে তা আর শোধরানো যায়নি। এ বার পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলের মতো দুই ‘বাম দুর্গে’ই যখন দল ক্ষমতার বাইরে, তখন এই ভুল শোধরানোর সুযোগ পাওয়া গিয়েছে। মতাদর্শগত দলিলে সেই দিশা নির্ণয়ের চেষ্টাই হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে আর ভুল না-হয়। সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, দলের নীতি অনুযায়ী অবশ্যই সরকার কাজ করবে। কিন্তু ‘আমলাতন্ত্র’ ও ‘দলতন্ত্র’, কোনওটাই যাতে সর্বগ্রাসী না হয়ে যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে ‘সতর্ক’ করার কাজ-ও করবে দল। কিন্তু প্রশাসনিক দায়িত্ব কখনওই আগ
বাড়িয়ে দল নিজের হাতে তুলে নেবে না। একই ভাবে সরকারকেও দলের কর্মী-সমর্থকদের বাইরে গোটা জনসমাজের কথা ভাবতে হবে। |
|
|
|
|
|