বাজারে সুদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এবং প্রকল্পগুলিকে আরও আকর্ষক করতে ডাকঘরের বিভিন্ন স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার বাড়াল কেন্দ্রীয় সরকার। যে তালিকায় রয়েছে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিপিএফ) এবং মাসিক আয় প্রকল্পের (এমআইএস) মতো প্রকল্প। কিছু ক্ষেত্রে মেয়াদে কাটছাঁটও করা হল।
এই প্রকল্পগুলি থেকে যে টাকা সরকারের ঘরে আসে, এত দিন তার ৮০ ভাগ ঢুকত রাজ্যের ভাঁড়ারে। কেন্দ্র এ দিন জানিয়ে দিল, এ বার থেকে রাজ্যের ভাগ কমে হয়ে যাচ্ছে ৫০ শতাংশ। স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে তালিকার গোড়ায়। এই সিদ্ধান্তে তাদের ভাঁড়ারে আরও এক দফা টান পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
কেমন হচ্ছে নতুন সুদের হার? ডাকঘর সেভিংস খাতে সুদের হার ৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হচ্ছে ৪ শতাংশ। এমআইএস এবং পিপিএফ-এ সুদের হার বেড়ে যথাক্রমে ৮.২ এবং ৮.৬ শতাংশ হচ্ছে। এ দিন সরকারি তরফে বিজ্ঞপ্তিতেই এ কথা জানানো হয়েছে। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সুদের হার সব চেয়ে বেশি বেড়েছে এক বছরের স্থায়ী আমানতে, ৬.২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭.৭ শতাংশ। আরও কয়েকটি স্থায়ী আমানত প্রকল্পেও সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। কবে থেকে এই নতুন সুদের হার কার্যকর হবে, সে সম্পর্কে খুব শীঘ্রই সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হবে।
সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বেশ কয়েক দফায় রেপো ও রিভার্স রেপো রেট বাড়িয়েছে। যার জেরে বেড়েছে ব্যাঙ্কের বিভিন্ন আমানত ও প্রকল্পে সুদের হার। কিন্তু ডাকঘরের আমানত ও স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পগুলি গত আট বছর ধরে একই সুদে আটকে। ফলে ডাকঘর ছেড়ে বহু গ্রাহক ব্যাঙ্কে চলে যাচ্ছেন। তা ঠেকাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর শ্যামলা গোপীনাথের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশগুলি মেনে নেওয়ার পথেই গেল কেন্দ্র। ডাকঘরে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পগুলি ঢেলে সাজার লক্ষ্যে গত বছর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ডেপুটি গভর্নর শ্যামলা গোপীনাথের নেতৃত্বে এই কমিটি গড়ে অর্থ মন্ত্রক। সেই কমিটিতে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থসচিব সি এম বাচাওয়াত-ও। কমিটির রিপোর্টেই পরিষ্কার করে দেওয়া হয়, ব্যাঙ্ক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থাকতে গেলে ডাকঘরের প্রকল্পগুলিকে আরও আকর্ষক করতে হবে। সে বিষয়ে একাধিক সুপারিশ করে কমিটি। আজকের বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট, তার অনেকগুলিই মেনে নিল সরকার। |

প্রস্তাবিত সুদের হার |
নতুন ১০ বছর মেয়াদি
এনএসসি-তে |
৮.৭% |
পিপিএফে |
৮.৬% (বছরে ১ লক্ষ টাকা
পর্যন্ত জমা রাখা যাবে) |
৫ বছরের মাসিক আয়
প্রকল্পে (এমআইএস) |
৮.২% |
৫ বছরের
রেকারিং ডিপোজিটে |
৮% |
১ বছর
মেয়াদি আমানতে |
৭.৭% |
সেভিংস
অ্যাকাউন্টে |
৪% |
বন্ধ করার প্রস্তাব |
• কিসান বিকাশ পত্র |
• মাসিক আয় প্রকল্পে
মেয়াদ শেষের ৫% বোনাস |
• পিপিএফ ও প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে
এজেন্টের কমিশন (কমিশন কমবে অন্যান্য প্রকল্পেও) |
কবে থেকে এ সব কার্যকর হবে,
শীঘ্রই তার ঘোষণা সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে |
|
এমআইএস, পিপিএফ থেকে সেভিংস খাত সুদের হার বেড়েছে প্রায় সব ক্ষেত্রেই। তবে তার সঙ্গে বদলেছে বিভিন্ন প্রকল্পের চেহারা। যেমন, এমআইএস-এর মেয়াদ ৬ বছর থেকে কমে হয়ে যাচ্ছে ৫ বছর। এনএসসি-র মেয়াদও কমে ৫ বছর হচ্ছে। তবে ১০ বছর মেয়াদি বিশেষ এনএসসি প্রকল্পও আনছে সরকার। আবার, ডাকঘরে পিপিএফে লগ্নির সীমা বছরে ৭০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লক্ষ টাকা করা হচ্ছে। এই নিয়ে গোপীনাথ কমিটির সুপারিশ ছিল, ৮০সি ধারায় আয়কর বাঁচাতে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত লগ্নি করতে পারেন সাধারণ মানুষ। চাইলে সেই পুরো লগ্নিটাই যেন ডাকঘরের পিপিএফে করা সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করতে সেখানে বিনিয়োগের সীমা ৭০ হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লক্ষ টাকা করা হোক। সেই সুপারিশ মেনে নিল সরকার। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে ব্যাঙ্কের পিপিএফের বার্ষিক লগ্নির সীমাও কি বাড়বে? ব্যাঙ্ককর্তাদের একাংশের বক্তব্য, এই নিয়ে তাঁরা কোনও সরকারি বিজ্ঞপ্তি পাননি। তবে তাঁদের আশা, ব্যাঙ্কেও পিপিএফে লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা এক লক্ষ টাকা হবে।
অন্য দিকে, তুলে দেওয়া হচ্ছে কিসান বিকাশ পত্র। এমআইএস প্রকল্পে মেয়াদ শেষে যে ৫% বোনাস পাওয়া যায়, তা-ও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে এজেন্টদের কমিশন হয় তুলে দেওয়া হবে, নয়তো অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হবে। যেমন, পিপিএফ ও প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে আর এজেন্ট কমিশন থাকবে না। আবার মহিলা প্রধান ক্ষেত্রীয় বচত যোজনায় কমিশন কমিয়ে অর্ধেক করে দেওয়া হচ্ছে।
এই কাটছাঁটের পিছনে কেন্দ্রের ব্যয়সঙ্কোচের উদ্দেশ্যও রয়েছে, মনে করছে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। বস্তুত, গোপীনাথ কমিটিই তাদের রিপোর্টে দেখিয়েছিল, ২০১০-১১ সালে এজেন্টদের পাওনা মেটাতে প্রায় ২৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ দিনের বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেকেরই মত, সেই খরচ কমাতে চাইছে সরকার। রাজ্যের ভাগ কমিয়ে তা দেশের পরিকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে লাগানোর প্রস্তাবও করা হয়েছে। ডাকঘর স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে টাকা রাখার ক্ষেত্রে সব থেকে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। এই বাবদ আদায় রাজ্যের অন্যতম বড় আয়ের উৎস। ভাগ ৮০ থেকে ৫০% হলে সেই উৎস জোর ধাক্কা খাবে বলে মনে করা হচ্ছে। |