পানাগড়ের জট খুলতে মাঝরাতে ‘দিদি’র গাড়ি আটক
মাঝপথে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি থামিয়ে দীর্ঘদিনের যন্ত্রণার অবসান চাইলেন পানাগড়ের মানুষ।
কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের পথে পানাগড় বাজারের সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা বহু দিন ধরেই যাত্রীদের ‘গলার ফাঁস’ হয়ে রয়েছে। পিছনে চার লেনের চওড়া রাস্তা, সামনেও তা-ই। মাঝে ওই অংশটুকু শুধু যেন শের শাহের আমলে পড়ে রয়েছে। ভাঙাচোরা রাস্তায় যানজট নিত্যসঙ্গী, দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
বৃহস্পতিবার মাঝরাতে তাই ঘাসফুল আঁকা পতাকা কাঁধে ‘দিদি’র পথ চেয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জনা তিরিশেক যুব তৃণমূল কর্মী। কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের দিকে ছুটে যাওয়া কনভয় চোখে পড়তেই তাঁরা পতাকা নাড়তে শুরু করেন। তা দেখেও পাইলট কার হুশ করে
পেরিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ‘দিদি’, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপেক্ষা করতে পারলেন না। গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে সব শুনলেন। দিলেন আশ্বাসও।
পানাগড়ে যানজট। নিজস্ব চিত্র
কেন্দ্রীয় স্বর্ণ চতুষ্টয় প্রকল্পে যখন পুরনো জি টি রোডের অংশ-সহ গোটা রাস্তা চার লেন হয়েছিল, দোকান-বাড়ি ভাঙতে না দেওয়ার ধুয়ো তুলে পথ চওড়া করতে দেননি পানাগড় বাজার এলাকারই কিছু বাসিন্দা। কলকাতা থেকে দুর্গাপুর হয়ে বরাকর পর্যন্ত যাতায়াতের গতি আটকে গিয়েছে ওই ছোট্ট ফাঁসে, শিল্পায়ন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যার প্রভাব অপরিসীম। সম্প্রতি মহাকরণে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রীরা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁরা কিছু অংশে খানাখন্দ মেরামত করেছেন। কিন্তু যেখানে মূল জট, সেই রেল ওভারব্রিজ থেকে দার্জিলিং মোড় পর্যন্ত মেরামতি বাকি রয়েছে কেন, সেই প্রশ্ন ওঠে। এর আগে মুখ্যসচিব সমর ঘোষের সঙ্গে বৈঠকে রাস্তাটি দু’দিকে সাত ফুট করে বাড়ানোর যে কথা বলা হয়, জানতে চাওয়া হয় সে বিষয়েও। এ মাসেই পূর্ত দফতর এবং জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের ইঞ্জিনিয়ারেরা যৌথ পরিদর্শনে যাবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু দিনের পর দিন সরকারি টালবাহানা দেখতে দেখতে অধৈর্য হয়ে পড়েছেন অনেকেই। পানাগড় মোড়ের বাসিন্দা প্রকাশ দাসের কথায়, “এক দিন বর্ধমান থেকে ফেরার সময়ে পাঁচ মিনিটের পথ যেতে বাসের লাগল আড়াই ঘণ্টা! পাগল-পাগল লাগছিল!” বেসরকারি সংস্থার কর্মী রামশঙ্কর দাসের কথায়, “গত ৩০ বছর ধরে এ-ই দেখছি। অফিস যাওয়া আর বাড়ি ফেরা একটা দুঃস্বপ্ন।” জট কাটাতে দু’টি পন্থা ভাবা হয়েছিল। এক, রাস্তা চওড়া করা। দুই, বাইপাস গড়ে ওই জায়গাটুকু এড়িয়ে যাওয়া। স্থানীয় ব্যবসায়ী অরূপ রায়ের কথায়, “২০০০ সাল নাগাদ রাস্তাটি দু’পাশে অন্তত ১৫ ফুট করে চওড়া করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে প্রায় সব ব্যবসায়ীই দোকান বা কারখানা পিছিয়ে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু প্রায় আট হাজার ব্যবসায়ীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ভেবেই সম্ভবত সরকার পিছিয়ে যায়। কিছু ব্যবসায়ী হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশও নিয়ে আসেন।”
এর পরে পানাগড় গ্রাম থেকে বুদবুদের কোটা মোড় পর্যন্ত একটি বিকল্প রাস্তা তৈরির কথা ভাবা হয়। পানাগড় গ্রামের আব্দুল জব্বার, লালু রাজবংশীদের মনে পড়ে, “দার্জিলিং মোড় থেকে কোটা মোড় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছ’কিলোমিটার জায়গা মাপজোক হয়েছিল। দেখা যায়, প্রায় দু’শো পরিবার বাসস্থান হারাবে। প্রচুর চাষজমিও যাবে। সম্ভবত ক্ষতিপূরণের বহর দেখেই সরকার ফের পিছু হটে।” অনেক সমীক্ষা ও আলাপ-আলোচনার পরে শেষমেশ চূড়ান্ত হয়েছে, পানাগড়ের আগে রেলসেতুর কাছ থেকে ছ’লেনের বাইপাস বের করে কাঁকসার গ্রামাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। দুর্গাপুরের দিকে দার্জিলিং মোড়ের কিছুটা পরে তা জি টি রোডে গিয়ে মিশবে।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রকল্প অধিকর্তা কৃষ্ণমুরারি বলেন, “বাইপাস তৈরির জন্য ইতিমধ্যেই একটি সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছে। ১৮০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে তাদের। জানুয়ারির শেষে কাজ শুরু হওয়ার কথা।” বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “এর জন্য আগে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে আমাদের। ডিসেম্বর থেকে তা শুরু হবে। কিছু দিনের মধ্যেই চাষিদের নিয়ে বৈঠক করে জমির দাম নির্দিষ্ট করা হবে।”
কাঁকসা ও পানাগড়ের যে সব এলাকা দিয়ে ওই বাইপাস যাওয়ার কথা, সেখানকার জমিমালিকেরাও প্রকল্পের গুরুত্ব সম্যক উপলব্ধি করছেন। কাঁকসা গ্রামের ক্ষুদ্র চাষি ফিরোজ খান, মহম্মদ এজিদেরা বলেন, “বাইপাস হওয়াটা সকলের পক্ষেই খুব জরুরি। তাতে যে শুধু যাতায়াতের সুবিধা হবে তা-ই নয়, এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে। বাজারদর এবং ক্ষতিপূরণের উপযুক্ত প্যাকেজ পেলে আমাদের জমি দিতে আপত্তি নেই।” তবে ১৮০ দিন অর্থাৎ মোটে ছ’মাসে যে কাজ মিটবে না, সে ব্যাপারে কর্তারা এক রকম নিশ্চিত। জেলাশাসকের মতে, “বাইপাস হতে আড়াই-তিন বছর লেগে যেতে পারে। তত দিন পুরনো জি টি রোড দিয়ে কাজ চালানো প্রায় অসম্ভব। রাস্তার মাত্র পাঁচ ফুট নিচে কাদার স্তর মিলেছে। গর্ত ঢাকা হলেও কিছু দিনের মধ্যে যে-কে-সেই!” তিনি জানান, আমূল সংস্কারের পাশাপাশি সাময়িক সুরাহা হিসেবে রাস্তার দু’পাশ পাঁচ ফুট করে চওড়া করার কথাও হয়েছে। তাতে বাড়িঘর ভাঙা পড়বে না, ফলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নও আসবে না। সব মিলিয়ে প্রায় ৬ কোটি টাকা লাগবে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ টাকা চেয়ে দিল্লিতে চিঠি পাঠাবেন। প্রকল্প অধিকর্তা কৃষ্ণমুরারি বলেন, “৬ কোটি টাকা হাতে পেলেই আমরা সংস্কারের কাজ শুরু করব।” কিন্তু ভুক্তভোগীরা আর বৈঠক, পরিদর্শন, চিঠিচাপাটিতে আস্থা রাখতে পারছেন না। এ বার তাঁরা চান ‘কাজ’।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক মমতা নিজে বারবার দ্রুত কাজের পক্ষে সওয়াল করে আসছেন। সম্ভবত সে কারণেই তাঁর গাড়ি আসতে দেখে মরিয়া হয়ে দৌড়েছেন পানাগড়ের তৃণমূল কর্মীরা। কাঁকসা ব্লক যুব তৃণমূল কোর কমিটির সদস্য সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সমস্যা দ্রুত মিটিয়ে ফেলার আশ্বাস দিয়েছেন দিদি।”
এই আশ্বাসই এখন তাঁদের বড় সম্বল।

(সহ প্রতিবেদন: সুব্রত সীট)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.