মোটামুটি ঘণ্টা দুয়েক উড়ান দূরত্বের ব্যবধানে আজ, মঙ্গলবার বিকালে জোড়া বৈঠকে বসছে ইউপিএ-২ সরকারের দুই শরিক কংগ্রেস-তৃণমূল।
বিকেল পাঁচটায় দিল্লির ৭ রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাসভবনে তাঁর কাছে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে তাঁদের ‘অবস্থান’ জানাবেন এবং ‘প্রাপ্য গুরুত্ব’ দাবি করবেন তৃণমূলের সাংসদরা। প্রায় একই সময়ে কলকাতার রাজভবনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসার কথা তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যে বৈঠকে রাজ্যের তরফে দাবি জানানো হবে ‘প্রাপ্য’ আর্থিক সুবিধা নিয়ে।
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানাতে মমতার পরামর্শে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছিল তৃণমূলের সংসদীয় দল। শেষ পর্যন্ত সোমবার লোকসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানানো হয়, মঙ্গলবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী সময় দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী এ দিনই তৃণমূলের অধিকাংশ সাংসদ দিল্লি রওনা হয়েছেন। বাকিরা যাবেন আজ সকালে। অন্য দিকে, প্রণববাবু এ দিন রাতেই কলকাতায় পৌঁছেছেন। আজ বিকেলে তিনি রাজভবনে যাবেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু বিষয়টি যে-হেতু রাজ্যের, তাই মমতা এবং অমিতবাবুও ওই বৈঠকে যোগ দেবেন বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। যদি না মমতা শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে না-চান। (বিভিন্ন কারণে এমনিতেই প্রণববাবুর উপর মমতা ‘ক্ষুব্ধ’) তবে পেট্রোলের দাম নিয়ে টানাপোড়েনের আগে থেকেই এই বৈঠকটি নির্ধারিত ছিল। কথা ছিল, গত শনিবার বৈঠক হবে। প্রণববাবু জরুরি কাজে দিল্লি চলে যাওয়ায় তা মঙ্গলবার করা হয়েছে।
ঘটনাচক্রে, কেন্দ্র এবং রাজ্যে দুই সরকারই চালাচ্ছে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। তফাত হল, দিল্লিতে সরকার টিকিয়ে রাখতে কংগ্রেস মমতার উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গে মমতার সে ‘দায়’ নেই। তবে আপাতত দু’দলের সম্পর্কে যে ‘টানাপোড়েন’ তৈরি হয়েছে, তাতে দু’টি বৈঠকেরই যথেষ্ট ‘তাৎপর্য’ রয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি, দুই শিবিরই ‘সমস্যা’ মেটাতে আগ্রহী। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ এ দিন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের বৈঠকে সমস্যা মিটে যাবে বলে আমি আশাবাদী।”
সোমবার কলকাতা ছাড়ার আগে সুদীপবাবু বলেন, “বোঝা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের অবস্থান ওঁকে জানাব। তিনি কী বলেন, তা দলনেত্রীকে জানানো হবে। নেত্রীর নির্দেশমতো পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।”
তাঁরা কি পেট্রোলের বর্ধিত দাম কমানোর (পরিভাষায় ‘রোল-ব্যাক’) দাবি করবেন? সুদীপবাবুর জবাব, “আমরা শরিক হিসেবে আমাদের প্রাপ্য মর্যাদার কথা বলব। বলব, শরিকদের মধ্যে সমন্বয় রাখা জরুরি। সংবাদমাধ্যম থেকে কেন আমাদের এমন সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানতে হবে?” দিল্লি রওনা হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা দলের প্রবীণ নেতা শিশির অধিকারীও বলেন, “আমরা কেন্দ্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক। যে ভাবে আমাদের বার-বার অগ্রাহ্য করা হচ্ছে, তা জোটের পক্ষে ভাল নয়।” সুদীপবাবুদের কথা থেকে স্পষ্ট যে, ‘রণং দেহি’ মনোভাব নয়, তৃণমূল বরং আগ্রহী কংগ্রেসের সঙ্গে ‘সমন্বয়’ রক্ষায়। দলের একাংশের মতে, প্রধানমন্ত্রীকে ‘সমন্বয় কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হবে। তিনি তা মেনে নিলে এ বারের মতো ‘যুদ্ধ-বিরতি’। তবে পাশাপাশিই আবেদন করা হবে রান্নার গ্যাস এবং ডিজেলের প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধি স্থগিত রাখারও। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায়, “এ ভাবে দিনের পর দিন বোঝা বাড়ানো মেনে নিতে আমরা রাজি নই।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা সংসদীয় দলের মারফৎ মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা বলে কেন্দ্রের উপর আগে থেকেই একটা ‘চাপ’ তৈরি করতে চাইছেন। যাতে রান্নার গ্যাস ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি আপাতত রুখে দেওয়া যায়। পাশাপাশিই তিনি মোকাবিলা
করতে চাইছেন বিরোধী সিপিএমের রাজনৈতিক আক্রমণেরও। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিনও বলেছেন, “গত বছর জুন মাসের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে পেট্রোলের দাম নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখানে তৃণমূল ছিল কি না, আমার জানা নেই। কিন্তু পরেও তারা ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কোনও বিবৃতি দেয়নি।”
এই পরিস্থিতিতে কৌশলে হাঁটছে কংগ্রেসও। ইউপিএ-র অন্য শরিক দলগুলিকে পাশে নিয়ে জোটের মধ্যে তৃণমূলকে ‘একঘরে’ করার প্রয়াস চালাচ্ছে তারা। সে দিক থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা নিয়েছেন এনসিপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার। খাদ্য সুরক্ষা বিল-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে মরাঠা নেতা কংগ্রেসকে উদ্বেগে রেখেছেন, তিনিই এখন সাফ জানাচ্ছেন, পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে তিনি সরকারের ‘পাশে’ রয়েছেন। জম্মু-কাশ্মীরের শাসক দল তথা ইউপিএ-র শরিক ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা মুস্তাফা কামালও এ দিন বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই পেট্রোলের দাম বেড়েছে। এই সার সত্যটা স্বীকার করে নিতে হবে। পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রথমে ‘বিরূপ’ প্রতিক্রিয়া জানালেও এ দিন ডিএমকে প্রধান করুণানিধি বলেছেন, “পেট্রোলের দাম বাড়ালে মানুষের অসুবিধা হয় ঠিকই, তবে আমরা সব সময় জোট ধর্ম মেনে চলি। সরকারকে বলেছি, ভর্তুকির বিষয়টা যাতে বিবেচনা করা হয়।”
তবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক শীর্ষনেতার আশা, সংসদীয় দলের মাধ্যমে সরকার থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিলেও এই মুহূর্তে মমতাও কোনও ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত নেবেন না। প্রথমত, ২০০১ সালের মমতার সঙ্গে ২০১১-র মমতার অনেক তফাত। এখন তিনি অনেক পরিণত বলে দলের নেতারাই মনে করছেন। মমতাও বলেছেন, “আমরা কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নেব না। কাউকে ব্ল্যাকমেল বা কারও সঙ্গে দর-কষাকষিও করছি না।’’ তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোট শরিক হিসেবে নিজেদের ‘প্রাপ্য মর্যাদা’র উপরেই তৃণমূল অনেক বেশি ‘গুরুত্ব’ আরোপ করছে। তাঁদের ‘অন্ধকারে রেখে’ গত ১২ মাসে ১১ বার পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়েই বেশি ‘ক্ষুব্ধ’ তৃণমূল নেতৃত্ব। মমতার কথায়, “যা হচ্ছে, সেই পদ্ধতিটাই মানতে পারছি না।”
বিভিন্ন সমস্যায় ‘জর্জরিত’ মনমোহন সরকার। মমতার সঙ্গে লড়াই যে আখেরে রাজনৈতিক ভাবে সরকারকে আরও দুর্বল করছে, তা-ও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কংগ্রেসের। এই অবস্থায় দল ও সরকারের একটি সূত্রে বলা হচ্ছে, কিছুটা কর কমিয়ে আপাতত মানুষকে খানিকটা সুরাহা দেওয়া যেতে পারে। কর কমিয়ে লিটার পিছু অন্তত ৫০ পয়সাও দাম কমানো গেলে উভয় পক্ষেরই ‘মুখরক্ষা’ সম্ভব। তাতে লাভবান হবে কংগ্রেসও। কারণ ঠেকায় পড়ে তারাও সরকারের কাছে পেট্রোলের দাম কমানোর আর্জি জানিয়েছে।
তবে কর কমালে কেন্দ্রকে আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। কর বাবদ কেন্দ্রের আদায় কম হলে তাতে রাজ্যগুলির অর্থ ভাণ্ডারেও প্রভাব পড়বে। কারণ পেট্রোপণ্যের ওপর চাপানো করের এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্র রাজ্যগুলিকেই দেয়। এই অবস্থায় কিছুটা হলেও আশার আলো দেখাচ্ছে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি এ দিন বলেন, ডলারের থেকে টাকা শক্তিশালী হলে তেলের দাম কিছুটা কমানো যেতে পারে। তাঁর মন্ত্রকের তরফে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি পক্ষের প্রথম ক’দিনে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৩ ডলার কমেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দিন দশেক পর পেট্রোলের দাম লিটারে ৩০ থেকে ৫০ পয়সা কম করা যেতে পারে। |