টেস্ট এখন ভারতীয় অদৃষ্ট বনাম ক্যারিবীয় ভাগ্য
পিল দেব উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, “জাতীয় প্রহসন!” লর্ডস টেস্টের প্রথম ইনিংসে কিপিং গ্লাভস খুলে ফেলে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নিজেই বল করতে নেমে পড়ায়। ভাবছিলাম, দিল্লিতে নিশ্চয়ই আছেন ভদ্রলোক। আর যদি না-ও থাকেন, মোবাইলে তো ধরলেই হয় কপিল, আজকেরটাকে কী বলবেন? জাতীয় ক্রিকেট কেলেঙ্কারি?
টেস্ট ম্যাচের সেকেন্ড ডে-তে নতুন বল নিয়ে ইনিংস শুরু করছে দুই স্পিনার! উপমহাদেশেই বা ক’বার ঘটেছে? নাকি আদৌ ঘটেনি। এমন নয় যে, স্পিনার জুড়ির নাম কুম্বলে-হরভজন। বা বেদী-প্রসন্ন। তা হলে বলা যেত পালিশওয়ালা বলে স্পিন করানোর অভিজ্ঞতা আছে এবং নিছক স্কিলই এই পরিস্থিতিতে তাঁদের বোলিং অর্ডারে পদোন্নতি ঘটিয়েছে। এখানে জড়িতদের এক জন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। বেচারি জীবনের প্রথম টেস্ট খেলছেন। অন্য জন প্রজ্ঞান ওঝার গোটা দশেক ম্যাচ পরে টিমে প্রত্যাবর্তন হয়েছে। প্রথম ইনিংসে ছয় ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান উইকেট তো কী, আবার খুব দ্রুতই যদি টিম থেকে তিনি ছিটকে যান, হায়দরাবাদের পানওয়ালাও জিজ্ঞেস করবে না, “প্রজ্ঞান ভাই, এন আইতু?” কন্নড় ভাষায় কী হল?
কোটলা পিচের বীভৎসতাই বোলিং অধিনায়ককে এঁদের সামনে আনতে বাধ্য করেছে। স্পিন তো বড় করানোর দরকার নেই। ক্যাপ্টেনের প্রেসক্রিপশন, উইকেট টু উইকেট রাখো। হাল্কা টার্নে। বল এত গড়াচ্ছে এবং হঠাৎ হঠাৎ ঘুরছে যে, কট বা বোল্ডের চেয়ে অনেক বিশ্বস্ত হবে এলবিডব্লিউ!
এডওয়ার্ডসের বলে এলবিডব্লিউ সচিন।
সারা দিনে পড়া ১৭ উইকেটের ১০টা নিয়েছে উইকেট। ভুল বোধহয়বাকিগুলোও নিয়েছে। উইকেট নিয়ে ব্যাটসম্যানের মানসিক চাপে। কোটলার পিচ প্রস্তুতকারক বেঙ্কট সুন্দরমকে কি এখনই বরখাস্ত করা উচিত নয় এমন সারফেস তৈরির জন্য? না আছে পেস। না বাউন্স। কোনও কোনও হোটেলের ছোট সাঁতারের পুলগুলোয় যেমন লেখা থাকে, সেফ ফর নন সুইমার্স, ওনলি ফোর ফিট ডিপ, তেমনই চার ফিটের বেশি এখানে দৈবাৎ এক-আধটা লাফাতে পারে। যারা এক মাস বাদে বাউন্স এবং পেসের দেশে বড় পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে তাদের জন্য ডিডিসিএ কী করে এই উইকেটের ব্যবস্থা রাখতে পারে?
লেখার ওপরের অনুচ্ছেদের অংশটা শুনে ডিডিসিএ কর্তা এক পাশে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, “ইন্ডিয়ান টিম অভিযোগ করবে তো? সিওর? মনে রাখবেন, তা হলে বেঙ্কট সুন্দরমও তৈরি।” এর পর যা বললেন, শুনে রূপঙ্করের অধুনা কলকাতা কাঁপানো গানটা মনে পড়ে গেল ‘গভীরে যাও, গভীরে!’ ডিডিসিএ-র বেসরকারি বয়ান অনুযায়ী তারা উইকেটের বাঁধুনি শক্ত রাখার জন্য ওপরের ঘাস রাখতে চেয়েছিল। ভারতীয় শিবিরের আপত্তিতে সেটা কাটতে হয়। ঘাস উড়িয়ে দেওয়াতেই নাকি তলার দিকটা এমন বালির মতো ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। ছোট সংযোজন। ম্যাচ পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে বীরেন্দ্র সহবাগ বলে গেলেন, “উইকেটের কোনও দোষ নেই।”
গত কাল লিখেছিলাম, সিরিজটা চন্দ্রপল বনাম ভারতীয় স্পিনার। কোটলা পিচের অধুনা যা অবস্থা, সেটাকে সাব-প্লট মনে হচ্ছে। নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেই খানিক জড়িয়ে পড়া ভারত এখন ১১৬ রানে পিছিয়ে। বিপক্ষের আরও আট উইকেট নিতে হবে। খেলা শেষ দিন অবধি গড়াবে না ছাড়া টেস্ট নিয়ে কোনও রকম ভবিষ্যদ্বাণীর উপায় নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ আড়াইশোর ওপারে চলে গেলে ভারতীয় মামলা গম্ভীর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আসলে যেখানে বল এত আস্তে আসে আর অবিরাম গড়ায়, সেখানে ক্রিকেটীয় বিচার একটা পর্যায়ের পর ওয়ান ওয়েতে আটকে যেতে বাধ্য। পূর্বাভাস একটাই হতে পারেভারতীয় অদৃষ্ট বনাম ক্যারিবীয় ভাগ্য!
দু’দলের অধিনায়ক ছাড়াও এ দিন কোটলায় আর একটা চাপক্লিষ্ট মুখ দেখলাম। ইনস্টেডিয়া বিজ্ঞাপন বিক্রি করেছেন এজেন্সির এমন এগজিকিউটিভের। কোটলা মাঠে কার্বন মোবাইল আর জেপি সিমেন্ট সংস্থার দু’টো বিশাল বিজ্ঞাপন দিয়েছে মাঠের ওপর দিকে। শেষোক্ত কোম্পানির বিজ্ঞাপনের সঙ্গে তেন্ডুলকরের অতিকায় কাটআউট। চেন্নাইয়ের রাস্তায় যেমন দক্ষিণ ভারতীয় নায়কদের দেখা যায়। ক্রিকেট মাঠের মধ্যের বিজ্ঞাপনের বিশেষত্ব হল, যত ওপরে উঠবে তত রেট কমবে। যত নীচে নামবে তত রেট বাড়বে। উল্টোটাই হওয়া উচিত, যেহেতু ওপরের বিজ্ঞাপনগুলো মাঠের দর্শক অনেক পরিষ্কার দেখতে পায়। নীচে কে কী পেরিমিটার বোর্ড লাগিয়েছে তা চোখেও পড়ে না সব সময়। তবু নীচেরটায় বেশি রেট, তার কারণ টিভি। টিভি কভারেজে ওপরটা ক্বচিৎ দেখায়। ক্যামেরা সব সময় থাকে নীচে। ক্রিকেট বিপণনের সহজ নিয়ম জো টিভি পে দিখতা হ্যায় ও বিকতা হ্যায়। একমাত্র বিক্রি টিভি-র ছবিতে। এজেন্সির পদস্থ এগজিকিউটিভের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ, তবু বড় শিল্পসংস্থাকে মোটা টাকায় তিনি ওপরের স্পেসটা বেচে দিতে পেরেছিলেন। তেন্ডুলকর-অ্যাঙ্গল এনে। ওঁর শততম সেঞ্চুরি হলে আপনাদের স্পেস নেওয়াটাও আর্কাইভের ভেতর থাকবে। ছবি-রেকর্ডে থেকে ঐতিহাসিক হয়ে যাবে এই সব বলে। আর তেন্ডুলকর কিনা মাত্র ৭ রানেই আউট। ফিডেল এডওয়ার্ডসকে ফ্লিক করতে গিয়েছিলেন। বল সামান্য নেমে যায় এবং স্বচ্ছতম এলবিডব্লিউ। তবু অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেন যাতে অন্তত নিজের শরীরীভাষা আম্পায়ারকে সংকেত না দেয়। ফ্রেমটা থেকে যদি কেউ সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, শততম সেঞ্চুরির চাপ প্রচণ্ড কামড়াতে শুরু করে দিয়েছে, তার সঙ্গে তর্ক জোড়ার উপায় নেই।
বল এত নিচু হচ্ছে যে কোটলায় এখন এই ভাবেই ব্যাট করতে হচ্ছে।
এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, নভেম্বরের দিল্লি নয়। নির্ঘাত জুলাইয়ের ইংল্যান্ড। নইলে অবিকল এক ছবি কী করে উঠে আসতে পারে। সেই পঞ্চাশ ওভারের কাছাকাছি অলআউট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ব্যাটিং লাইন আপ। সেই তেন্ডুলকর ব্যর্থ। সেই রাহুল দ্রাবিড় এক দিক আগলে। শেষ দশ উইকেট গেল মাত্র ১২০ রানে। তার মধ্যে দ্রাবিড় একা ৫৪। ভারতে এই দৃশ্যই বা ক’বার দেখা যায় যে, এক জন করে নতুন ব্যাটসম্যান নামছে আর তিনিদ্রাবিড় আগাম হেঁটে যাচ্ছেন তাঁর দিকে দশ-পনেরো গজ। পিঠে হাত দিয়ে বোঝাচ্ছেন। আশ্বস্ত করছেন, সে বাইশ গজে পৌঁছনোর অনেক আগেই। এ সব দৃশ্য দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ায় দেখা যায়। যেখানে পরিবেশ অপরিচিত। দর্শক বিরোধী। বিপক্ষ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। বা ফোর্থ ইনিংসে চাপের মুখে রান তাড়া করছে। নিজের দেশে লক্ষ্মণ-ধোনি-যুবরাজকে গিয়ে যদি প্রথম ইনিংসে আগাম কথা বলে আশ্বস্ত করতে হয়, তা হলে পিচ কতখানি খারাপ বোঝাই যাচ্ছে!
তাও তো প্রথম উইকেটে হওয়া ৮৯ রানের পিছনে ভাগ্যের বদান্যতা রয়েছে। গম্ভীরের দু’বার স্লিপে ক্যাচ পড়ল। সহবাগ বোল্ড হয়ে বেঁচে গেলেন ডেলিভারিটা ‘নো’ বল ঘোষিত হওয়ায়। ফিডেল এডওয়ার্ডসের কোটলা পিচে অসহায়তা দেখে মনে হচ্ছিল, সত্যিই তো তাঁর এখানে এলবিডব্লিউয়ের জন্য স্টাম্প টু স্টাম্প বল করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। অথচ তাঁর যদি ডেনিস ওয়েটের মতো ফিজিও থাকত। লয়েড-রিচার্ডস-হেনেসকে নিয়ে দুর্ধর্ষ সেই স্লিপ কর্ডন থাকত। যদি চাপ শেয়ার করার মতো আর দু’জন থাকত, তিনিও অনায়াসে ক্ষয়িষ্ণু পেস প্রজন্মের আইকন হতে পারতেন। এ তো পুরনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের মহেঞ্জোদরো। নইলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম বোলার পরিবর্তনে এখন কিপার স্টাম্পের পাশে দাঁড়ায়! নমুনা, সোমবারের ডারেন স্যামি। যাঁর জন্য কালর্টন বাও আগাগোড়া সামনে থাকলেন। এটাও কত অভিনব পরিবর্তন। রবি শাস্ত্রী যা দেখে বলছিলেন, “হায়, আমাদের খেলার সময়ও যদি এত দ্রুত বসন্তের আগমন হত!”
ধোনিদের বসন্তের এখন কী হয়, মঙ্গলবার ক্রিকেটসমাজ আগ্রহের সঙ্গে দেখবে। ঈদের জন্য কোটলার আশেপাশের রাস্তা এ দিন অফিস টাইমের ডালহৌসি হয়ে গিয়েছিল। কাছে দরগা আছে। মসজিদ আছে। আছে ফিরোজ শাহের সমাধিস্তম্ভ। যা কত মানুষের নমাজ পড়ার জায়গা। ঈদের এই হাসিমুখগুলোর পাশে কোটলা এক-একটা উইকেটের পতনে ‘শক’-এ বুজে যাচ্ছিল।
বিষণ্ণতার সেরা রং বোধহয় জনগোষ্ঠীর নির্বাক মুখ। শততম সেঞ্চুরি পিছনে চলে গিয়ে এখন ক্রিকেট ভারতের আর্তি মুখগুলো যেন তৃতীয় দিনে সবাক হতে পারে! সবাক এবং সরব!
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
কোটলা টেস্টের স্কোর
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস (আগের দিন ২৫৬-৫)
চন্দ্রপল এলবি ডব্লিউ ইশান্ত ১১৮,
বাও এলবিডব্লিউ প্রজ্ঞান ২৭,
স্যামি এলবিডব্লিউ প্রজ্ঞান ৫,
রামপল এলবিডব্লিউ অশ্বিন ১২,
ফিডেল এডোয়ার্ডস ক সহবাগ বো প্রজ্ঞান ১০,
বিশু নঃআঃ ০,
অতিরিক্ত ১৩,
মোট ৩০৪।
পতন: ২৫, ৪৫, ৭২, ১৮০, ২০০, ২৬৯, ২৮১, ২৮১, ৩০৪।
বোলিং: ইশান্ত ২৫-৫-৮০-১,
উমেশ ১৯-৫-৫২-০,
প্রজ্ঞান ৩৪.২-৯-৭২-৬,
অশ্বিন ২৭-৪-৮১-৩,
সহবাগ ২-০-৫-০,
যুবরাজ ১-০-২-০।
ভারত প্রথম ইনিংস
গম্ভীর রান আউট ৪১,
সহবাগ স্টাঃ বাও বো বিশু ৫৫,
দ্রাবিড় ক স্যামি বো রামপল ৫৪,
সচিন এলবিডব্লিউ ফিডেল এডোয়ার্ডস ৭,
লক্ষ্মণ ক বাও বো বিশু ১,
যুবরাজ ক কার্ক এডোয়ার্ডস বো স্যামি ২৩,
ধোনি বো স্যামি ০,
অশ্বিন ক বাও বো স্যামি ০,
ইশান্ত ক বাও বো স্যামুয়েলস ১৭,
প্রজ্ঞান নঃআঃ ৩,
উমেশ বো রামপল ০,
অতিরিক্ত ৮,
মোট ২০৯।
পতন: ৮৯, ১০০, ১১৩, ১২০, ১৫২, ১৫২, ১৫৪, ২০৩, ২০৯।
বোলিং: ফিডেল এডোয়ার্ডস ১১-১-৫৭-১,
রামপল ১৪.৫-২-৪৪-২,
স্যামি ৮-১-৩৫-৩,
বিশু ১৪-০-৫৫-২,
স্যামুয়েলস ৫-০-১৩-১।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
ব্রাথওয়েট এলবিডব্লিউ প্রজ্ঞান ২,
পাওয়েল ক গম্ভীর বো অশ্বিন ০,
কার্ক এডোয়ার্ডস ব্যাটিং ১৫,
ফিডেল এডোয়ার্ডস ব্যাটিং ০,
অতিরিক্ত ৪,
মোট ২১-২।
পতন: ০, ১৭।
বোলিং: প্রজ্ঞান ৭-৩-৭-১,
অশ্বিন ৬-৩-৮-১,
যুবরাজ ১-০-২-০।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.