বিরোধিতার মুখেও কুড়ানকুলামের পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পিছু হঠছে না মনমোহন সরকার। বরং প্রকল্পটি সম্পর্কে তামিলনাড়ু সরকার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের যাবতীয় আপত্তি ও আশঙ্কা দূর করতে যথাসাধ্য তৎপর এখন কেন্দ্র।
মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা প্রকল্পটির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে রেখেছেন, ‘স্থানীয় মানুষ বিরোধিতা করছেন’ এই যুক্তি দেখিয়ে। তার উপর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের মতো ব্যক্তি প্রকল্পটিকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে ছাড়পত্র দেওয়া সত্ত্বেও প্রকল্প-বিরোধীরা অবস্থান না পাল্টানোয় কেন্দ্র কিছুটা রুষ্টই। কেন্দ্রীয় সরকারের স্পষ্ট বক্তব্য, কুড়ানকুলাম নিয়ে পিছু হঠার কোনও প্রশ্ন নেই। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের ১৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি কাল তিরুনেলভেলিতে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। কুড়ানকুলাম নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কেন্দ্র-রাজ্য বৈঠক এই প্রথম। কালামের রিপোর্টের প্রসঙ্গ উঠবে সেখানেও।
কারণ, কালাম স্পষ্টই জানিয়েছেন, কুড়ানকুলামের ক্ষেত্রে পরমাণু বিপর্যয়, বিকিরণজনিত বিপর্যয়, উচ্চতাপ উৎপাদন করার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা বা প্রকল্পের গঠনগত দিক থেকে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিশোধন অঞ্চল থেকে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ারও আশঙ্কা নেই। মানুষের মনে বিপদের আশঙ্কা ঢোকানো হয়েছে বাইরে থেকে। কিংবা নিছক অজ্ঞানতার ফলেই তৈরি হয়েছে এই পরিস্থিতি। কালামের এই বক্তব্য জানার পরেও বরফ না গলায় আজ একই সঙ্গে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য কে বালু। এক সময় ভাবা পরমাণু কেন্দ্রে পরমাণ বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বালুর কথায়, “কালাম দেখে আসার পরেও প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি দূর হল না এটা দুর্ভাগ্যজনক। সমস্যাটা কোথায়, সেটা খুঁজে বার করতে হবে আমাদের।” ভারতের ‘মিসাইল ম্যান’ কালামের আশ্বাসেও বিরোধিতা দূর না হওয়াকে ‘দুঃখজনক’ আখ্যা দিয়েছে রাশিয়াও। রুশ দূতাবাসের মুখপাত্র সের্গেই কার্মালতো বলেছেন, “কুড়ানকনামে যা ঘটছে তা দুর্ভাগ্যজনক। নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সব ব্যবস্থাই নিয়েছি। আমরা আশা করব, ভারত বিরোধিতা মিটিয়ে ওখানে চুল্লি বসানোর ব্যবস্থা করবে।
এর আগে বিরোধিতা এসেছে পশ্চিমবঙ্গের হরিপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। আপত্তি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মনমোহন সরকার কিন্তু মনে করছে, হরিপুরেও রাশিয়ার প্রযুক্তিতে পরমাণু কেন্দ্র তৈরি হলে কোনও বিপদ হত না। বরং রাজ্যের বিদ্যুৎ সমস্যা মিটত। একই ভাবে কুড়ানকুলামেও পরমাণু কেন্দ্র তৈরি হলে জয়ললিতার রাজ্যে বিদ্যুৎ সঙ্কট মিটবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, ওই কেন্দ্রে প্রথম দু’টি চুল্লিতে যে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, তার মধ্যে ৯২৫ মেগাওয়াটই পাবে রাজ্য। জয়ললিতা নিজেও তা জানেন। তাই জাপানের ফুকুশিমা দাইচিতে বিপর্যয়ের পর যখন কুড়ানকুলামের বাইরে বিক্ষোভ শুরু হয়, তখন তিনি বিক্ষোভ বন্ধ করার আবেদনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, জনসমর্থন হারানোর কথা ভেবে তিনিও বেঁকে বসেন। তামিলনাড়ুতে পঞ্চায়েত নির্বাচন চলছে। তাই রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে চাননি এডিএমকে নেত্রী। সুকৌশলে বিরোধিতার মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রের দিকে।
কিন্তু যে মনমোহন সিংহ ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে প্রথম ইউপিএ সরকারকেই বাজি ধরেছিলেন, তিনি এই রাজনৈতিক বিরোধিতার সামনে মাথা নোয়াতে রাজি নন। বস্তুত একই কারণে ফুকুশিমা দাইচির পরমাণু-বিপর্যয়ের পরে কুড়ানকুলামের আতঙ্কিত বাসিন্দারা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে পদক্ষেপ করতে দেরি করেননি প্রধানমন্ত্রী। ১৫ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে দিয়েছিলেন তখনই। কমিটির সদস্য বালু জানিয়েছেন, স্থানীয় বাসিন্দা তথা মৎস্যজীবীদের আশঙ্কার দিকগুলি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। ঠিক হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের একটি প্রতিনিধিদলকে অন্যান্য পরমাণু কেন্দ্র পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানকার কর্মচারীরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশেই যে সপরিবারে দীর্ঘদিন বাস করছেন, তা-ও দেখানো হবে।
পরমাণু শক্তি নিগমের কর্তারা বলছেন, হরিপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের বিরোধিতায় ওই প্রকল্পের জন্য এখন অন্যত্র জায়গা খুঁজতে হবে। কিন্তু কুড়ানকুলামের পরিস্থিতি অন্য। সেখানে কাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। একটি চুল্লি চালু হওয়ার অপেক্ষায়, অন্যটির মাত্র ৫ শতাংশ কাজ বাকি। ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গিয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে আরও চারটি চুল্লি তৈরির চুক্তি হয়েছে। এই অবস্থায় তাই পিছু না হঠে, সব রকম চেষ্টাই চালাচ্ছে কেন্দ্র। বিশেষজ্ঞ কমিটি তার কাজ করছে। পাশাপাশি কালামকে কুড়ানকলামে পাঠানোর পিছনেও একটা হিসেব কাজ করেছে কেন্দ্রের। তা হল, পরমাণু-বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির। তায় তামিলভাষী হওয়াও স্থানীয়রাও তাঁর ভাষা বুঝবেন। কালাম নিজেও জানিয়েছেন, স্রেফ কেন্দ্রীয় সরকারের দূত হয়ে আসেননি তিনি। আজও তিনি বলেছেন, ফুকুশিমা-দাইচির পুনরাবৃত্তি এড়ানোর উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাই রয়েছে কুড়ানকুলামে। কালাম তামিলনাড়ু সরকারকে “কুড়ানকুলাম-পুরা” নামে যে দশ দফা পরিকল্পনা জমা দিয়েছেন, তাতে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের মোটরচালিত নৌকা, মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমঘর তৈরি ছাড়াও বহুতল আবাসন, গ্রিন হাউস গড়া, পানীয় জলের সুব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়াও রয়েছে আবাসিক বিদ্যালয়, গ্রামগুলিতে ইন্টারনেটের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া, বিপর্যয় মোকাবিলা কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব। ২০০ কোটি টাকার এই প্রস্তাবের মধ্যে ১০ হাজার চাকরির সুযোগ, চারটি লেনের হাইওয়ে এবং একটি বিশ্বমানের হাসপাতালের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরকার মনে করছে, আখেরে কালামের তৎপরতায় সুফল মিলবেই। তবে কালকের বৈঠকে রাজ্যের প্রতিনিধিরা কী অবস্থান নেন, কেন্দ্র এখন তারই অপেক্ষায়। |