চলতি দশকের শেষে ভারতের প্রতিটি পরিবারে ক্যানসারে আক্রান্ত অন্তত এক জন মানুষ থাকবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ইতিমধ্যে এই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে।
বিশ্ব সংস্থার এ হেন সতর্কবাণী মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ক্যানসার-মহামারী’ ঠেকাতে রাজ্যগুলোকে বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হতে নির্দেশ দিয়েছে। এবং সেই নির্দেশ মেনেই এ বার তিরিশ বছরের উপরে যে কোনও মহিলা বা পুরুষকে বিশেষ ‘স্ক্রিনিং’-এর আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দফতর। ‘বিশেষ স্ক্রিনিং’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
স্বাস্থ্য দফতরের খবর: কোনও ক্যানসার রোগীকে নিয়ে তাঁর পরিবারের কেউ যে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গেলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক রোগীর পাশাপাশি তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। প্রয়োজনীয় কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে তাঁর দৈনন্দিন অভ্যেসগুলো জেনে নিয়ে রোগীর ওই পরিজনকেও ক্যানসার ঠেকানোর প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন চিকিৎসকেরা। শুধু তা-ই নয়, ক্যানসার-চিকিৎসা পরিষেবাকে রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে দিতে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ এক-একটা জেলাকে ‘দত্তক’ নেবে বলেও স্থির হয়েছে।
স্বাস্থ্য-কর্তারা মনে করছেন, বর্তমান পরিকাঠামোয় ক্যাম্প করে সাধারণ মানুষের কানসার সংক্রান্ত প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। পরিবারে ক্যানসার থাকলে কারও বিশেষ কাউন্সেলিংও এই পরিকাঠামোয় করা কঠিন। উপরন্তু এই জাতীয় শিবিরে আম নাগরিকের উপস্থিতির হার নিয়েও চিকিৎসকেরা তেমন আশাবাদী নন। এই পরিস্থিতিতে স্থির হয়েছে, ক্যানসার সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে যাঁরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে যাচ্ছেন, সমস্যা মোকাবিলার পথ বাতলাতে সরকার তাঁদের কাছাকাছি পৌঁছাতে চেষ্টা করবে। জেলাস্তরে ক্যানসার-চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে কলকাতার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়মিত জেলায় পাঠাতেও উদ্যোগী হয়েছে স্বাস্থ্য দফতর।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা জানিয়েছেন, একটা সময় পর্যন্ত দেশে ‘কমিউনিকেব্ল ডিজিজ’ (যা এক জন থেকে আর জনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে)-এর প্রকোপ বেশি ছিল। গত ক’বছরে ছবিটা বদলে গিয়েছে। ক্যানসার, হার্টের অসুখ, ডায়াবিটিস ও স্ট্রোক এই চারটি ‘নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ’-এর দাপট দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে ক্যানসার সম্পর্কে বাড়তি হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে হু। তাদের মতে, চলতি দশকের শেষাশেষি ভারতে এই রোগ মহামারীর চেহারা নেবে। যে কারণে ‘স্ক্রিনিং’কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কী ভাবে হবে এই স্ক্রিনিং?
এনআরএসের রেডিওথেরাপি-র প্রধান চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় একটা নমুনা দিচ্ছেন। বলছেন, “ধরা যাক, কোনও যুবক তাঁর ক্যানসারে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। বাবার চিকিৎসা তো হবেই। ছেলের কাছেও জেনে নেওয়া হবে, তিনি ধূমপান করেন কি না, বেশি তৈলাক্ত খাবার খান কি না, শরীরচর্চা করেন কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর ওজন পরিমাপ, সাধারণ কিছু রক্ত পরীক্ষা বা এক্স রে-ও করানো যেতে পারে।” আর এ থেকেই খানিকটা আঁচ মিলতে পারে যে, ছেলেরও ক্যানসারের কবলে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে কি না। সেই অনুযায়ী তাঁর জীবনযাত্রায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পরামর্শও ডাক্তারেরা দিতে পারবেন বলে সুবীরবাবুর দাবি।
পাশাপাশি ৩০ থেকে ৬৯ বছর বয়সী মহিলাদের জরায়ু-মুখ (সার্ভিক্যাল) ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য প্যাপ স্মেয়ার পরীক্ষা এবং স্তন ক্যানসার নির্ণয়ে ম্যামোগ্রাফিরও পরিকল্পনা রয়েছে। এ জন্য জেলা স্তরে ম্যামোগ্রাফি যন্ত্র কেনা হবে। রাজ্যের কার্যনির্বাহী স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ক্যানসার প্রতিরোধের কাজে মেডিক্যাল কলেজগুলোকে আরও বেশি করে যুক্ত করতে চাইছি। প্রতিটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে নোডাল অফিসার নিয়োগ করা হবে। তাঁরাই নজরদারি করবেন।” স্বাস্থ্য দফতর-সূত্রের খবর: রাজ্যের এক-একটা মেডিক্যাল কলেজ এক-একটা জেলাকে ‘দত্তক’ নেবে। চিকিৎসকেরা মাসে এক বার সেখানে গিয়ে সব কিছু দেখে-শুনে আসবেন।
গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা ক্যানসার রোগীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা চিকিৎসার জন্য শহরে আসা। ঘটিবাটি বিক্রি করে এসেও দীর্ঘ হয়রানির শিকার হন তাঁরা। এর সুরাহায় জেলাস্তরে ক্যানসার নির্ণয়, কেমোথেরাপি ও কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসারের অস্ত্রোপচার চালু
করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। এ জন্য প্রাথমিক ভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ছ’টি জেলাকে। কিন্তু ঘোষণার দেড় বছর পরেও কাজ শুরু হয়নি। অধিকাংশ জেলা হাসপাতালে বায়পসি পর্যন্ত হয় না! স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে সরকারি দরেই সেখানে বায়পসি-সহ অন্যান্য পরীক্ষার বন্দোবস্ত করার কথা বলা হয়েছিল। এখনও কোথাও সেই চুক্তি হয়ে ওঠেনি!
আগের পরিকল্পনাগুচ্ছের যখন এমন হাল, তখন এই নতুন উদ্যোগ যে বাস্তবায়িত হবে, তার নিশ্চয়তা কী? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার আশ্বাস: কোনও ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না।
এ বার কী কী হতে চলেছে, তার তালিকাও দিচ্ছেন তিনি। যেমন, অল্প কিছু দিনের মধ্যে প্রতি জেলায় এক জন ক্যানসার-চিকিৎসক নিয়োগ করে সপ্তাহে তিন দিন আউটডোর ও এক দিন ‘টিউমার বোর্ড’ বসানো হবে। জেলায় ক্যানসারের কিছু কিছু অস্ত্রোপচারও হবে।
খাতা-কলমের গণ্ডি পেরিয়ে পরিকল্পনা দিনের আলো কবে দেখবে, আপাতত
তারই অপেক্ষা।
|