ব্যবস্থা নয়, রাজ্য আবেগ নিয়েই চক্ষুদানের দৌড়ে
রিকাঠামো নেই। সম্বল শুধু আবেগ!
আর স্রেফ সেই আবেগে ভর করেই তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র বা গুজরাতের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে পশ্চিমবঙ্গ! চক্ষুদানের প্রতিযোগিতায়।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, স্বেচ্ছায় চক্ষুদানে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রের মতো রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বহু যোজন এগিয়ে। যথাসময়ে চোখ সংগ্রহ ও তা সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার সুফল পাচ্ছে তারা। অন্য দিকে তা করতে না-পারায় পশ্চিমবঙ্গ থমকে আছে প্রায় এক জায়গাতেই।
চক্ষুদানে উৎসাহ দিতে গত ক’বছরে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর নানা আবেগকে কাজে লাগিয়েছে। তাতে ফলও মিলছে, দিন দিন বেশি সংখ্যক মানুষ চক্ষুদানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু ঠিক সময়ে চোখ তুলে সংরক্ষণের ব্যবস্থার অভাবে পুরো উদ্দেশ্যটাই মাটি! অনেক ক্ষেত্রে জেলায় সংগৃহীত দানের চোখ কলকাতায় পৌঁছাতে ২২ ঘণ্টাও লেগে যাচ্ছে, ফলে তা ব্যবহারযোগ্যই থাকছে না! জেলায় জেলায় চক্ষুব্যাঙ্ক বা চোখ সংরক্ষণের পরিকাঠামোই যে সে ভাবে গড়ে ওঠেনি!
এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য দফতর পরিকাঠামো-সমস্যার সুরাহায় অগ্রাধিকার দেবে, এটাই প্রত্যাশিত ছিল। পরিবর্তে নতুন ‘দূত’কে পুরোভাগে রেখে নতুন করে চক্ষুদানের প্রচারে নামছে স্বাস্থ্য দফতর! সরকারের দাবি, এতে আরও মানুষকে চক্ষুদানে উদ্বুদ্ধ করে তোলা যাবে। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা না-থাকলে উৎসাহীদের দান করা চোখের হাল কী হবে, তার সদুত্তর কোথাও নেই।
চক্ষুদানের প্রচারে রাজ্যের নতুন ‘দূত’ কে?
দান খতিয়ান
রাজ্য ২০০৯ ২০১০
তামিলনাড়ু ৮৫৯৬ ৮৮০০
গুজরাত ৬৫৪৮ ৬৬০০
মহারাষ্ট্র ৪৭৯০ ৫০০০
অন্ধ্রপ্রদেশ ৪৫৬৮ ৪৪০০
কর্নাটক ২৬২২ ৩২০০
হরিয়ানা ১৩৭৪ ২৪০০
পশ্চিমবঙ্গ ১৫৫১ ২৩৬২
তিনি কোনও ‘সেলিব্রিটি’ নন। বরং বারাসতের নবপল্লির বাসিন্দা ওই বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন নিছকই আম-আদমি। গত ২৩ অক্টোবর বয়সজনিত অসুস্থতায় তাঁর মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য দফতরের দাবি: শতায়ু বিশ্বনাথবাবু মরণোত্তর চক্ষুদান করে গিয়েছিলেন। বাড়ির লোক তাঁর চোখ দু’টো এনআরএসের অতুলবল্লভ চক্ষুব্যাঙ্কে দেন। তা দিয়েই পৃথিবীর আলো দেখেছেন দুই দৃষ্টিহীন।
এত প্রবীণ মানুষের চোখ দিব্যি কাজে লেগে যাওয়ায় ডাক্তারেরা যথেষ্ট উৎসাহিত। এনআরএসের চক্ষুব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক অনিল ঘাটার বক্তব্য, “সাধারণ ধারণা হল, নব্বই পার করা মানুষের কর্নিয়ার মান খারাপ হয়ে যায়। তাই অতি প্রবীণদের চোখ নিতে চিকিৎসকেরা খুব একটা চাড় দেখান না। কিন্তু বিশ্বনাথবাবুর কর্নিয়া পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা প্রতিস্থাপনযোগ্য।”
স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর, ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পরে বিশ্বনাথবাবুর পরিবারেরই বিভিন্ন বয়সের অন্তত ছ’জন মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকার করে ফেলেছেন। তা জানতে পেরে স্বাস্থ্য দফতর প্রয়াত বিশ্বনাথবাবুকে এ রাজ্যের চক্ষুদান-দূত হিসেবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আর এখানেই উঠে আসছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি বিশ্বনাথ দত্তের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হবেন যাঁরা, তাঁদের সবার চোখ সংগ্রহ ও কর্নিয়া সুস্থ রেখে তা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা স্বাস্থ্য দফতর করতে পারবে কি?
বস্তুত এ নিয়ে সংশয় ঘোরতর।
পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে সরকারি চক্ষুব্যাঙ্ক সাকুল্যে তিনটে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল লাগোয়া রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি (আরআইও), এনআরএসের চক্ষুব্যাঙ্ক ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের চক্ষুব্যাঙ্ক। উপরন্তু পরিকাঠামো ও ডাক্তারের অভাবে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের চক্ষুব্যাঙ্কে কাজ প্রায় বন্ধ। অন্য দিকে তামিলনাড়ু, গুজরাত, মহারাষ্ট্রে সরকারি চক্ষুব্যাঙ্ক যথাক্রমে ২২, ১৯ এবং ৩৯টি। প্রতিটাই সক্রিয়।
পরিকাঠামোর এই দুর্দশার খেসারত দিচ্ছেন রাজ্যের দৃষ্টিহীনেরা। অধিকাংশ জেলায় চোখ তোলা ও প্রতিস্থাপন হয় না। স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে দৃষ্টিহীনের সংখ্যা আনুমানিক ৬০ হাজার। ফি বছর এখানে দু’-আড়াই হাজার শিশুর কর্নিয়া নানা কারণে নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সংরক্ষণের বন্দোবস্ত না-থাকায় দূর-দূরান্তের পথ পেরিয়ে কলকাতায় আনতে গিয়ে কাজের বার হয়ে যাচ্ছে দান করা অসংখ্য কর্নিয়া। প্রতিস্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত কর্নিয়া মিলছে না।
এমন অবস্থা কেন? স্বাস্থ্য দফতরের চক্ষু বিভাগের অতিরিক্ত অধিকর্তা সুনীল ভৌমিকের ব্যাখ্যা, “কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য জেলায় যথেষ্ট সংখ্যায় সার্জন পাওয়া যাচ্ছে না। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে টাকা নেই বলে কেউ আগ্রহী নন। আবার সার্জন না-থাকায় জেলায় জেলায় চক্ষুব্যাঙ্ক করা যাচ্ছে না।”
তবু চক্ষুদানের ‘প্রচারে’ রাজ্য সরকার বছরে ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করছে। প্রতি জেলা পাচ্ছে ৫০ হাজার টাকা।
যাকে আদতে ভস্মে ঘি ঢালা ছাড়া আর কিছু বলে মনে করতে নারাজ চিকিৎসক ও চক্ষুদান আন্দোলনে জড়িতদের একাংশ। যাঁদের প্রশ্ন, শুধু আবেগ দিয়ে যে গুজরাত-তামিলনাড়ু-মহারাষ্ট্রকে হারানো সম্ভব নয়, সরকার কি তা আদৌ বুঝতে পেরেছে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.