স্বাস্থ্যের ভার নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন অচলায়তনে ঝাঁকুনি দিতে। আচমকা হাসপাতালে-হাসপাতালে
হানা দিতে শুরু করেছিলেন। শৃঙ্খলার ছাপ পড়েছিল পরিষেবায়। পাঁচ মাস পরে ছবিটা কেমন?
গত ৩১ অক্টোবর, সোমবার মহানগরের তিন হাসপাতালে ঘুরল আনন্দবাজার। |
সাতসকাল নয়। বেলা গড়াতে গড়াতে প্রায় সাড়ে এগারোটা।
আউটডোরে থিকথিক করছে রোগী। ওঁরা টিকিট কেটে সকাল ন’টা থেকে বসে রয়েছেন অধীর অপেক্ষায়। কিন্তু আউটডোর তো ‘নিয়মমাফিক’ সওয়া ন’টায় খুলে গিয়েছে!
দেখা গেল, শুধু দরজাই খুলেছে। ডাক্তারদের পাত্তা নেই! ঠিক পাঁচ মাস আগে, গত পয়লা জুন যাদবপুরের এই বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে আচমকা হানা দিয়ে একই ছবি দেখেছিলেন সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখে প্রচণ্ড বিরক্তও হয়েছিলেন। এবং পরে মহাকরণে বলেছিলেন, “এ বার এগুলোর পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের প্রেক্ষিতে রাজ্যের সহ-স্বাস্থ্য অধিকর্তা (পরিকল্পনা)-কে তড়িঘড়ি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালের বেহাল দশা বদলানোর ব্যবস্থা নিতে। সহ-স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে এ-ও বলা হয়েছিল, ব্যবস্থাগ্রহণের কাজ তদারক করতে তিনি নিজে যেন দু’সপ্তাহ সেখানে উপস্থিত থাকেন।
অবস্থা কি বদলেছে?
রোগীরা বলছেন, “দিদি ঘুরে যাওয়ার পরে ঘরগুলো ঠিক সময়ে খুলছে। কিন্তু ডাক্তার কোথায়?” দু’-এক জন বাদ দিলে অধিকাংশ ডাক্তার সময়ে আসেন না বলে জানাচ্ছেন রোগীরা। দোতলায় প্রসূতি আউটডোরে দেখা গেল, ভিতরে দু’জন নার্স ও এক মহিলা কর্মী। ডাক্তার নেই। গড়িয়া থেকে আসা এক মহিলার হতাশ মন্তব্য, “ন’টায় ডাক্তার আসার কথা। এখনও দেখা নেই।” পাশের ঘরে অবশ্য এক জন ইএনটি যথাসময়ে এসেছেন। |
খাঁ খাঁ মেল ওয়ার্ড। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
বাইরের বেঞ্চে মায়ের কোলে শুয়ে কাঁপছিল বছর পনেরোর প্রশান্ত দাস। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত কিশোরটির ম্যালেরিয়া হয়েছে কি না, জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছেন ডাক্তার। রক্ত পরীক্ষার ঘরের সামনে অসুস্থ ছেলেকে নিয়েও গিয়েছিলেন মা। গিয়ে শোনেন, টেস্ট করবেন যিনি তিনি এসে পৌঁছাননি। অগত্যা নেতিয়ে পড়া ছেলেকে কোলে আঁকড়ে সময় গুনছেন মা। হাসপাতালেরই এক কর্মী বললেন, “আজ তো তবু ছ’জন ডাক্তারের দু’জন সময়মতো এসেছেন! পরশু এক জনও আসেননি। সুপারও ছিলেন না। এ দিকে শ’দুয়েক রোগী আউটডোরে! সামাল দিতে শেষে ওয়ার্ড থেকে এক ডাক্তারকে আউটডোরে আনতে হল!”
সময়ানুবর্তিতার অভাবের পাশাপাশি রয়েছে আরও মারাত্মক অভিযোগ। চিকিৎসকের নেশাগ্রস্ত আচরণ। যেমন?
কালীপুজোর দিন বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল থেকে ছুটি পাওয়া প্রশান্ত গোস্বামী এসেছিলেন চেক-আপের জন্য। ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা প্রশান্তবাবু বললেন,“এখানকার এক ডাক্তার সকালে নেশা করে এসে রোগী দেখেন। যে ক’দিন ভর্তি ছিলাম, প্রতিবাদ করেছি। ফল হয়নি।” প্রশান্তবাবু যে নিছক ‘কথার কথা’ বলছেন না, হাসপাতালের একাধিক কর্মীর কথাতেও সেই ইঙ্গিত।
এত সব যে ঘটে যাচ্ছে, কর্তৃপক্ষ কিছুই জানেন না?
একতলায় সুপারের ঘরে ঢুকে দেখা গেল, চেয়ার ফাঁকা। ফ্যান ঘুরছে। টেবিলে রাখা হাজিরা-খাতা। খেয়াল-খুশিমতো এক-এক জন ডাক্তার আসছেন। খাতায় সই করছেন। সুপার কোথায়? জানানো হল, ‘কাজে আছেন। আসতে দেরি হবে।’ বেলা সাড়ে বারোটায় অবশ্য জানা গেল, সুপার রয়েছেন ছুটিতে। |
বাঘা যতীন স্টেট জেনারেল |
কী বলেছিলেন |
কী হয়েছে |
• আরও সার্জন লাগবে |
• আছেন এক জনই |
• ডাক্তার সময়ে আসবেন |
• অধিকাংশ দেরিতে আসেন |
• ইমার্জেন্সি অপারেশন চালু হবে |
• চালু হয়নি |
• ডাক্তার ও কর্মী বাড়বে |
• ডাক্তার বেড়েছে এক জন |
• পরিষেবা নিশ্চিত হবে |
• তেমন উন্নতি নেই। |
|
ঘুরে দেখা গেল, সব দিকেই ‘নেই’-এর রাজত্ব। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এক জন সার্জন নিয়ে হাসপাতাল চালানো যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় শল্য চিকিৎসক আসেননি। মেডিসিনেও ডাক্তার এক জন। চিকিৎসকের অভাবে গত জানুয়ারি ইস্তক দন্ত বিভাগে তালা ঝুলছে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পরে বারুইপুর থেকে এক জন চক্ষু চিকিৎসক সপ্তাহে দু’দিন আসছেন বলে পরে জানান সুপার বিকাশ মণ্ডল। কিন্তু সার্বিক ভাবে হাসপাতালের হাল যে বদলায়নি, বিকাশবাবু তা মেনে নিচ্ছেন। বলছেন, “পয়লা জুনের পরে এখনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। যা ছিল, তাই আছে।” ডাক্তারেরা সময়ে আসেন না কেন? ছুটিতে থাকা বিকাশবাবুর জবাব, “শুনেছি, আমার অনুপস্থিতিতে কেউ কেউ দেরিতে আসছেন। দেখছি।”
ডাক্তার হাতে গোনা। পাশাপাশি একশো শয্যার হাসপাতালে কর্মীর সংখ্যাও নগণ্য বলে জানিয়েছেন সুপার নিজেই। বস্তুত ভর্তি হয়ে কোনও লাভ নেই বলে ওয়ার্ডও ফাঁকা। চারতলায় চল্লিশ শয্যার মেল (জেনারেল) ওয়ার্ডে রোগী বড় জোর পাঁচ জন! তাঁদের এক জনের আক্ষেপ, “পেট ভরে খেতেও দেয় না!” হাসপাতাল-সূত্রের খবর: দৈনিক শ’চারেক রোগী আউটডোরে আসেন। চিকিৎসা নিয়ে অভিযোগ প্রায় সবারই। পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর কথায়, “নামেই সরকারি হাসপাতাল। সব ওষুধই তো কিনে খেতে হয়!” কেন?
হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, “সিএমওএইচের কাছে ৪৩ রকমের ওষুধ চেয়েছিলাম। পেয়েছি ১১ রকমের। বাকিগুলো নেই বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
হাসপাতালটির উন্নতির জন্য কী কী করা জরুরি, মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পরে সে সম্পর্কে সুপারিশ-রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন সহ স্বাস্থ্য-অধিকর্তা সত্যপ্রিয় ভট্টাচার্য। সুপারিশগুলো এখনও কার্যকর হল না কেন?
সত্যপ্রিয়বাবুর জবাব, “রিপোর্ট অনেক আগে জমা দিয়েছি। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।” |