রাজনৈতিক অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু সংগঠন এতই দুর্বল যে, সেই অস্ত্র কাজেই লাগাতে পারছে না আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে ইউপিএ সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার হুঁশিয়ারি দিয়েছে তৃণমূল। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় পাল্টা জানিয়ে দিয়েছেন, পেট্রোলের দামের উপর নিয়ন্ত্রণ উঠেছিল শরিকদের মত নিয়েই। যে অভিযোগ আগেই তুলেছিলেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ও পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাট। প্রণববাবুর গত কালের মন্তব্য তাঁদের সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করেছে বলেই সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দাবি। তাঁদের মতে, এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ‘দ্বিচারিতা’-র অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামার ‘সুবর্ণ সুযোগ’ রয়েছে। কিন্তু তা হাতছাড়া করতে চলেছেন রাজ্য নেতৃত্ব।
সিপিএম পলিটব্যুরোর মতে, কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে বিভাজন তৈরির যে কৌশলের পক্ষে রাজ্য নেতারা গলা ফাটান, সেই কৌশল গ্রহণের এটাই উপযুক্ত সময়। অথচ দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু পেট্রোলের দাম নিয়ে শুধু বিবৃতি দিয়েই ‘দায়িত্ব পালন’ করেছেন। এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন হবে কি না, মমতার ‘দায়িত্বের’ প্রসঙ্গ তুলে প্রচার করা হবে কি না, সেটাই এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি আলিমুদ্দিন।
সমস্যাটা কোথায়? এ কে জি ভবনের নেতারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরলেও দল ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। সেখানে নতুন সরকার গঠনের পর থেকেই রাস্তায় নেমে পড়েছে সিপিএমের রাজ্য কমিটি, ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠনগুলি। ছাত্রদের বিক্ষোভে পুলিশের গুলি চলেছে। যুব সংগঠনের বিক্ষোভে পুলিশ লাঠি চালিয়েছে, রক্তপাত হয়েছে। তাতেও দমে যায়নি কেউ। পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতার হাতবদলের ফলে পিনারাই বিজয়নরা লড়াকু বিরোধিতা করতে ভুলে যাননি। উল্টো দিকে, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ক্যাডাররা পুলিশের লাঠি-কাঁদানে গ্যাসের সঙ্গে লড়তে ভুলে গিয়েছে। অতীতে দেশে যখন আইন অমান্য বা জেল ভরো-র ডাক দেওয়া হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে ‘নিজেদের পুলিশ’-এর সঙ্গে বাম নেতারা লড়াইয়ে নামতে চাননি। তারই ফল টের পাওয়া যাচ্ছে এখন। তা ছাড়া, নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে দলের সাংগঠনিক হাল এখন এত খারাপ যে, আন্দোলন গড়ে তোলাই দায়। বহু জেলায় অসংখ্য দলীয় কর্মী বসে গিয়েছেন। পার্টি অফিস খোলার লোক মিলছে না। আন্দোলন তো দূর অস্ত।
ফলে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পেট্রোলের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শনিবার কেরলে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি বেসরকারি পরিবহণ ক্ষেত্রে ধর্মঘট পালন করলেও পশ্চিমবঙ্গে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়নি। সিটুর রাজ্য কমিটির এক শীর্ষনেতা বলেন, “আমরা এখন ৮ তারিখের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির জেল ভরো কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। ওই দিকেই মনোনিবেশ করছি।” কিন্তু সিটুর কেন্দ্রীয় দফতর বি টি রণদিভে ভবনের নেতাদের প্রশ্ন, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের মতো কিছু সুনির্দিষ্ট দাবিতে জেল ভরো কমর্সূচির সঙ্গে অন্য আন্দোলনের সম্পর্ক কোথায়!
পলিটব্যুরো মনে করছে, রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে কতটা কড়া সুর নেওয়া হবে, তা নিয়ে প্রথম থেকেই দ্বিধায় রয়েছে আলিমুদ্দিন। বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্র গঠনমূলক বিরোধিতার রাস্তা নিয়েছিলেন। তাই দেখে আবার নিচু স্তরে সবাই ভেবে বসলেন, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলনই করা যাবে না। এখনও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ-আন্দোলন কতটা হবে, তা নিয়ে দ্বিধায় সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব।
আলিমুদ্দিনের নেতাদের কারও কারও মতে, এই মুহূর্তে রাজ্যের সাধারণ মানুষের কাছে দলের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ফলে মমতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামলে কোনও ফলই হবে না। আপাতত দলের উচিত কিছু দিন চুপ থাকা। সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাল্টা যুক্তি, সরকার পরিচালনা নিয়ে এখনই সমালোচনা না করা হতে পারে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন করা যাবে না কেন! বিশেষ করে মমতা নিজেই যখন ওই সিদ্ধান্তের শরিক!
সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য অবশ্য দাবি করেন, “আন্দোলনের কর্মসূচি নেই এমন নয়। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, খাদ্য সুরক্ষা আইন দাবিতে গোটা দেশে নভেম্বর মাস জুড়ে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সন্ত্রাস, শিক্ষা নীতি, কৃষকদের দুরবস্থা, জ্যোতি বসু নগরের নাম বদলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদেও প্রচার চলছে। ২১ থেকে ২৫ নভেম্বর সব জেলা ও মহকুমায় আন্দোলন হবে। ২৯ নভেম্বর কলকাতায় আইন অমান্য।”
কিন্তু পেট্রোল? আলিমুদ্দিনের এক নেতা রসিকতা করে বলেন, “পেট্রোলে আগুন ধরানোর ইচ্ছে আমাদেরও রয়েছে। অথচ দেশলাইটা এখনও ভিজে। আগুনের ফুলকি তৈরি হতে আরও সময় প্রয়োজন।” |