বামফ্রন্টের এখন টানাটানির সংসার। ‘রোজগেরে’ সদস্যদের সংখ্যাও কমেছে সংসারে। যে ক’জন উপায় করছেন, তাঁদেরই তাই বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে নিতে হচ্ছে! ‘পরিবর্তনে’র ঝড়ে সিপিএম-সহ বামফ্রন্টের সব শরিক দলের
বিধায়ক সংখ্যাই অনেক কমে গিয়েছে। ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দলগুলির আয়ের যে পথ ছিল, স্বাভাবিক কারণেই সে সব শুকিয়ে এসেছে। অগত্যা বিধায়কদের আয় থেকেই দলের রোজগার বাড়াতে সক্রিয় হয়েছেন বাম নেতৃত্ব। বাম শাসনের ‘সুবাদে’ই এ রাজ্যে বিধায়কদের
বেতন ও ভাতার অঙ্ক অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কম। মূল্যবৃদ্ধির বাজারে নিজেদের সংসার টানতেই জেরবার যে মধ্যবিত্ত জনতা, জনপ্রতিনিধি হিসাবে বিধায়কেরাও তার বাইরে নন। কিন্তু দলের ‘দুর্দিনে’ নিজেদের পাশাপাশি দলের সংসারটা দেখতে হচ্ছে তাঁদের!
রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে ভাঁড়ারে টান পড়ায় বিধায়কদের ‘লেভি’র অঙ্ক বাড়াতে হচ্ছে
সিপিএম-কে।
একই পথে হাঁটতে হচ্ছে ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি-র মতো বাম শরিকদেরও। বিধায়কেরা তাঁদের সরকারি বেতন থেকে যে অংশ দলীয় তহবিলে দিতেন (লেভি), এ বার থেকে তা বাড়াতে বলছেন বাম নেতৃত্ব। সিপিএম ইতিমধ্যেই নির্দেশিকা জারি করে দলীয় সাংসদদের ‘লেভি’ পুনর্বিন্যাস করেছে। বিধায়কদের জন্য রাজ্য পার্টির নির্দেশিকা, তাঁরা যেন সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নতুন ‘লেভি’র পরিমাণ ঠিক করে নেন।
আরও এক ধাপ এগিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নির্দেশিকা জারি করেছে, প্রাক্তন বিধায়কদের পেনশন থেকে যে ‘লেভি’ দলীয় তহবিলে আসত, তা-ও এ বার বাড়াতে হবে। যদিও এ বার ‘প্রাক্তন’-হওয়া বিধায়কদের বেশির ভাগ
এখনও পেনশন হাতেই পাননি! আরএসপি তাদের সাম্প্রতিক রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে ঠিক করেছে, সাংসদ এবং বিধায়কদের কাছে আরও ‘আর্থিক সহযোগিতা’ চাইবে।
সিপিএম এবং অন্য বাম শরিক দলগুলি বরাবরই দলীয় সদস্যদের ‘লেভি’ এবং গণসংগ্রহের উপরে নির্ভরশীল। অন্তত প্রকাশ্যে। তবে দলীয় সদস্যেরা জানেন, ক্ষমতায় থাকাকালীন দলের হাতে-থাকা দফতরগুলি দল চালাতে অন্যতম ‘ভরসা’ ছিল। এখন সে ‘ভরসা’ উধাও। অতএব, ভার নিতে হচ্ছে বিধায়কদের। বাম জমানার শেষ দিকে বিধায়কদের সরকারি বেতন এক বার বেড়েছে, ‘পরিবর্তনে’র পরে বেড়েছে ভাতা। বাম দলগুলির নেতৃত্ব চাইছেন, দলের ‘সঙ্কটে’ কিঞ্চিৎ ‘আত্মত্যাগ’ করুন বিধায়কেরা!
বিধানসভা ভোটের পরে গত কয়েক মাসের হিসাব পরীক্ষা করতে গিয়ে বাম নেতৃত্ব দেখেছেন, জেলা থেকে ‘লেভি’-বাবদ রাজ্যের প্রাপ্ত অংশ ঠিকমতো পৌঁছচ্ছে না। তার অন্যতম কারণ, জেলায় জেলায় বিধায়কদের সংখ্যা কমে গিয়েছে। তার প্রেক্ষিতেই বিধায়কদের ‘লেভি’ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এক বিধায়কের কথায়, “সাংসদদেরটা ঠিক হয়ে গিয়েছে। বিধায়কদের ক্ষেত্রে জেলা পার্টির সঙ্গে কথা বলে পরিমাণ ঠিক করতে হবে।” সিপিএমের এক ‘স্বভাবরসিক’ বিধায়কের মন্তব্য, “যখন বেতন আর ভাতা বাড়ল, তখনই জানতাম বিশেষ খুশি হওয়ার কিছু নেই! কারণ, পার্টি বেশি টাকা কাটবে! সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যখন, এটা করতেই হত।”
যাঁরা চাকরি করেন এবং যাঁদের চাকরি বা অন্য আয়ের উৎস নেই এই দু’ধরনের বিধায়কের জন্য দু’রকমের ‘লেভি’র পরিমাণ ঠিক করে দিয়ে ফ ব-র নির্দেশিকায় বলা
হয়েছে, ‘নতুন নতুন বাধা, আক্রমণ ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আমরা। নতুনতর সংগ্রাম ও লড়াইয়ের জন্য আমাদের পার্টিকেও নতুন ভাবে গড়ে তুলতে হবে। এই কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। আপনাদের সকলের সাহায্য ও সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব’।
শুরুর আগে একই রাস্তায় হাঁটার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়ে ফেলেছে আরএসপি-ও। বাম শরিক সিপিআই অবশ্য এখনও এমন কোনও
সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “রাজ্য থেকে আমাদের তিন জন সাংসদ ছিলেন, এখনও তা-ই। বেশির ভাগ জেলায় আমাদের বিধায়ক ছিলেন না। এখনও নেই। বিধায়ক না-থাকলে আর কী ‘লেভি’ বাড়াব? এক ধাক্কায় পাঁচ জন বিধায়ক হারিয়ে ক্ষতি হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের। তাদের হয়তো কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।” প্রসঙ্গত, পূর্ব মেদিনীপুরে এখন কোনও বাম বিধায়কই নেই!
মাগ্গি-গন্ডার বাজারে সম্মেলন-পর্বে ব্যয়বাহুল্য ছেঁটে ফেলার
নির্দেশও জারি হয়েছে সিপিএমে। কিন্তু জেলায় জেলায় ‘সন্ত্রাসের শিকার’ দলীয় সদস্য-সমর্থকদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, বহু জায়গায় আশ্রয় শিবির চালাতে খরচ হচ্ছেই। পশ্চিমবঙ্গে ‘সন্ত্রাসে’র প্রেক্ষিতে বামফ্রন্টের প্রতি ‘সহমর্মিতা’র কর্মসূচিতে চাঁদা তুলে কিছু
অর্থসাহায্য করেছে কেরল সিপিএম। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের কথা ভেবে সেই ‘সাহায্য’ও যখের ধনের মতো আগলে রাখতে হচ্ছে আলিমুদ্দিনকে! |