গ্রাম পঞ্চায়েতের মহিলা প্রধানদের সম্প্রতি সতর্ক করিয়াছেন বিহারের পঞ্চায়েত মন্ত্রী ভীম সিংহ। তিনি বলিয়াছেন, কোনও মহিলা প্রধান যদি স্বামীকে পঞ্চায়েতের বৈঠকে অংশগ্রহণ করিতে, কিংবা কাজ করিতে পাঠান, তাহা হইলে ওই মহিলার জরিমানা কিংবা আরও গুরুতর কোনও শাস্তি হইতে পারে। ইহার পূর্বে রাজস্থানে একই ভাবে ‘সরপঞ্চ পতি’ অর্থাৎ মহিলা প্রধানের স্বামীর বকলমে প্রধানের কাজ করিবার প্রথাকে নিয়ন্ত্রণ করিবার চেষ্টা করা হইয়াছিল। কিন্তু তাহা ফলপ্রসূ হয় নাই। তবু বিহারের পঞ্চায়েত মন্ত্রীর ধন্যবাদ প্রাপ্য। তিনি একটি সমস্যাকে চিহ্নিত করিয়াছেন এবং সমাধান খুঁজিতেছেন। দায় লইতে রাজি না থাকিলে অধিকার পাইবার দাবি করা চলে না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় প্রথমে ৩৩ শতাংশ, পরে ৫০ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণের যে ব্যবস্থা হইয়াছে, তাহার উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হইয়া যায় যদি মহিলা সদস্য স্বামীর আড়ালে রহিয়া যান। বরং বিপরীতই সাধিত হয়, কারণ অধিকাংশ মানুষের নিকট এই বার্তাই পৌঁছায় যে মহিলাদের কার্যভার দিলেও তাঁহারা তাহা পালন করিতে অক্ষম।
এই পরিস্থিতির জন্য মেয়েদের শিক্ষা ও উদ্যোগের অভাবকেই অধিকাংশ ব্যক্তি দায়ী করিয়া থাকেন। কিন্তু একটু তলাইয়া ভাবিলে স্পষ্ট হয় যে, ইহার প্রধান দায় রাজনৈতিক দলগুলির। পশ্চিমবঙ্গ বা কেরল ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলি পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রার্থী না করিলেও, প্রার্থী মনোয়নের ক্ষেত্রে তাহাদের প্রচ্ছন্ন প্রভাব থাকে। ইহা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় যে, সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী মনোনয়ের সময়ে প্রভাবশালী নেতাদের পরিবার হইতেই মহিলাদের বাছিয়া লওয়া হয়। প্রত্যন্ত গ্রামেও কিছু মহিলা এমন থাকেন যাঁহারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি, মহিলা সমিতি কিংবা সমাজসেবা মূলক কাজ করেন। তাঁহাদের নিজস্ব পরিচিতি এবং প্রভাব রহিয়াছে। তাঁহাদের স্বশাসনে অংশীদার করা রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্য। সংবিধান সংশোধন করিয়া মহিলা সংরক্ষণের উদ্দেশ্য তাহাই ছিল। দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক দলগুলি সুপ্রশাসন এবং সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্য হইতে এতটাই বিচ্যুত হইয়াছে, যে প্রধানের স্ত্রী-কন্যাকে তাঁহার আসনে
বসানোই তাঁহাদের স্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়। যে কোনও মূল্যে নিয়ন্ত্রণ ধরিয়া রাখিতে হইবে, ইহাই রাজনীতির উদ্দেশ্য। তাহার ফলে মহিলা কিংবা নিম্নবর্গের প্রশাসনে যোগদানের উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হইয়া গেলেও তাহা ‘সামান্য ক্ষতি’ বলিয়া মনে হয়
নেতাদের। দূরদর্শিতার অভাব হইলে এমনই ঘটিয়া থাকে, তাই ইহা আশ্চর্য নহে।
আজ বাস্তব ইহাই যে, যে মহিলা প্রধান হইয়াছেন, তিনি অনেক ক্ষেত্রেই নিজে প্রশাসনে যোগ দিবার সিদ্ধান্ত নেন নাই। কিন্তু পঞ্চায়েত পরিচালনার উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা তাঁহার আছে কি? দায়িত্বপালনের জন্য উপযুক্ত সময় কিংবা সামর্থ্য তাঁহাকে যোগাইতে রাজি নহে তাঁহার পরিবার, সমাজ কিংবা রাজনৈতিক দল। তিনি স্বামীর নির্দিষ্ট স্থানে সই করিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। এই মহিলার উপর সরকারি শাস্তির খাঁড়া নামিয়া আসিলে তাহা কার্যত একের অপরাধে অন্যের শাস্তি হইয়া দাঁড়াইবে। ভীম সিংহের চিন্তায় এই সত্যটির প্রতিফলন নাই। কিন্তু তাঁহার এই ঘোষণা হয়তো বহু মহিলাকে এ বিষয়ে সচেতন করিবে যে, স্বামীর হাতে দায়ভার সঁপিয়া দেওয়া রাষ্ট্রের নির্দেশ নহে। সমাজ-পরিবার যাহাই বলুক, রাষ্ট্র মহিলাদের জন্য গৃহকর্মের বাইরে বৃহত্তর কাজের পরিধি রচনা করিয়াছে। তাঁহার জন্য নির্দিষ্ট স্থান তিনি গ্রহণ না করিলে তাহা অপরাধ। এ বার বাহির না হইলে নহে। |