আবার এক দফা পেট্রোলের দাম বাড়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হইয়া কেন্দ্রীয় শাসক জোট ইউ পি এ হইতে ইস্তফা দেওয়ার হুমকি দিয়াছেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জি-২০-র সম্মেলন হইতে প্রধানমন্ত্রীর দেশে ফেরার অপেক্ষায় রহিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী শরিক দলের চাপ বা হুমকির কাছে নত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়াইয়া দিয়াছেন। বর্তমানে পেট্রোপণ্যের দর যে সরকার বাড়ায় না, তেল উৎপাদক ও আমদানিকারী সংস্থাগুলি বাজার অনুযায়ী তাহা নিরূপণ করে, এ তথ্য জানা থাকিলে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করায় দ্বিধা থাকিত। এখন কেবল পেট্রোপণ্যের ক্ষেত্রে যাহা ঘটিতেছে, অদূর ভবিষ্যতে অন্য যাবতীয় পণ্যের ক্ষেত্রেই সে ভাবে বাজারের হাতেই দর নির্ণয়ের অধিকার অন্তরিত হইয়া যাইবে। সরকার তথাপি দরবৃদ্ধিজনিত দুর্ভোগ ও অসুবিধা লাঘব করিতে উৎপাদন ও আমদানি শুল্কে রকমারি ছাড় দিয়া চলিয়াছে। এই ছাড় বা ভর্তুকির জন্য রাজকোষ হইতে বহু অর্থ চলিয়া যাইতেছে, যাহা পরিকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের তহবিলে জমা হইতে পারিত।
অভিজ্ঞ রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এ সব কথা জানেন না, তাহা নয়। কিন্তু রাজনীতি করেন বলিয়াই তাঁহাকে জনসাধারণের উপর বোঝা চাপিবে, এমন ব্যবস্থার প্রতিবাদও করিতে হয়। তবে মমতা নিজে এখন আর বিরোধী নেত্রী নহেন, একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, নিত্য তাঁহাকে সরকার চালাইতে হয়। তিনি কি বুঝিতেছেন না যে, সরকার চালাইতে গেলে তহবিল লাগে? নিশ্চয় ইহাও তিনি বুঝিতেছেন যে, লোকসান করিয়া কোনও সংস্থা দীর্ঘ কাল চালু থাকিতে পারে না। লাভের মুখ যদি নাও দেখে, অন্তত খরচ তুলিয়া লইবার মতো রাজস্ব নবরত্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকেও ক্রেতা-গ্রাহকদের কাছ হইতেই সংগ্রহ করিতে হয়। তাহা না করিতে পারিলে এক দিন সংস্থাগুলিতেই লালবাতি জ্বলিয়া ওঠার সম্ভাবনা। জনমনোরঞ্জক সব প্রকল্প, ভর্তুকিনির্ভর বিভিন্ন কর্মসূচি বিতরণ করিয়া শাসকরা ভোট কুড়াইবার চেষ্টা করেন। কিন্তু জনতোষণ করিতে গিয়া রাজনীতির কারবারিরা সরকারের তহবিল রিক্ত করিয়া দেন। এখানেই বাজারের শক্তিকে অর্থনীতিতে প্রবাহিত করার প্রয়োজন, উদারনৈতিক আর্থিক সংস্কারের আবশ্যকতা। মনমোহন সিংহ নিজে সেই সংস্কারের জনক হইয়া কেমন করিয়া পেট্রোপণ্যের দরনির্ণয়ের দায়িত্ব উৎপাদক বা আমদানিকারকদের হাত হইতে কাড়িয়া লন? পিছানোর প্রশ্ন নাই তাঁহার এই অঙ্গীকারের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে না ফেরার সেই শপথই প্রতিফলিত। মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় এখনও জনতোষণে দৃঢ়সঙ্কল্প। তাই রান্নার গ্যাসে আগের দফার মূল্যবৃদ্ধির প্রতিকূল প্রভাব লাঘব করিতে তিনি রাজ্যের তহবিল হইতে সিলিন্ডার-পিছু ভর্তুকি ঘোষণা করেন। তাঁহার দলের নিয়ন্ত্রিত কলিকাতা পুরসভা সম্পত্তি কর আদায়ে গড়িমসি করিতেছে কিংবা জল-কর না-বসানোয় জিদ ধরিয়া আছে। তাঁহারই নির্দেশে রেলের ভাড়া এখনও দলীয় মন্ত্রী দিনেশ ত্রিবেদী বাড়াইতে পারেন না। কোষাগার শূন্য, ধারে দেনায় সরকারি সংস্থাগুলি জর্জরিত। উপরন্তু প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে গতি সঞ্চারের কাজটি থমকিয়া আছে। বামপন্থীরা ভর্তুকিনির্ভর নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি মারফত জনপ্রিয়তা টিকাইয়া রাখিতে গিয়া বাজারের শক্তিকে অস্বীকার করিতে সচেষ্ট ছিলেন। ইহা যে ভ্রান্ত ও বিপথগামী নীতি, তাহা উপলব্ধি করিতে তাঁহাদের ত্রিশ বছর লাগিয়া গিয়াছে। মমতা একটু দ্রুত শিখিলে মঙ্গল। |