বিলম্ব কথাটা বিনিয়োগের বাজারে চলে না। সময় মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা কার্যকর করা লগ্নির জগতে সাফল্যের মূলমন্ত্র। সুযোগ আসে এবং চলেও যায়। সময় থাকতে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। লগ্নির তারতম্য ঘটে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। যে বয়সে যা করা উচিত, তা না করা হলে পরে আফসোস করতে হয়।
একটি শিশুর জন্মের বছর থেকেই শুরু করতে হয় তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লগ্নি-পরিকল্পনা। বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার খরচ যে ভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা মাফিক নিয়মিত সঞ্চয় না করে গেলে প্রয়োজনের সময় সমস্যায় পড়তে হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে উপযুক্ত প্রকল্পে অল্প অল্প করে জমিয়ে গেলে তা খুব একটা গায়ে লাগে না। ক্রমপুঞ্জিত সুদ-সহ গড়ে ওঠে বিরাট একটি তহবিল। প্রয়োজনে তা অত্যন্ত কাজে আসে।
এলআইসি-সহ প্রত্যেকটি বিমা সংস্থারই আছে শিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। প্রকল্প আছে মিউচুয়াল ফান্ডেও। দীর্ঘ মেয়াদে টাকা জমানো যেতে পারে ব্যাঙ্কের রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে। সুদের হার এখন বেশ আকর্ষণীয়। দীর্ঘ মেয়াদে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে টাকা লগ্নির আর একটি ভাল জায়গা হল মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যালান্সড প্রকল্প।
ধুমধাম করে সন্তানের বিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা যাঁদের আছে, তাঁদেরও পরিকল্পনা করতে হবে সময় মতো। সোনার দাম যে-ভাবে বাড়ছে, তাতে অর্থসঞ্চয় ছাড়াও নিয়মিত কিনে রাখা যেতে পারে সোনা অথবা স্বর্ণপত্র।
বাড়ি, গাড়ি অথবা অন্য কোনও মূল্যবান সামগ্রী কেনার পরিকল্পনা থাকলে পুরোটা ঋণ না নিয়ে আগে থেকে কিছুটা জমিয়ে নিলে সুবিধা হয়। চড়া সুদের বাজারে এতে ইএমআই কিছুটা কমবে এবং তাতে সুবিধাই হবে।
নতুন যাঁরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন, প্রথমেই তাঁদের উচিত হবে একটি পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলা। সম্ভব হলে প্রতি বছর এখানে জমাতে হবে ৭০ হাজার টাকা। মনে রাখতে হবে, এখানে করছাড়ের সুবিধা আছে জমা ও সুদ উভয়ের উপরেই। নিয়মিত টাকা রাখলে ১৫ বছর মেয়াদি এই অ্যাকাউন্টে জমে ওঠে করমুক্ত একটি বিরাট তহবিল। স্বনিযুক্ত ব্যক্তি, যাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুবিধা নেই, তাঁদের অবশ্যই উচিত হবে পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খোলা। ১৫ বছরের পর বাড়ানোও যায় এই অ্যাকাউন্টের মেয়াদ।
বয়স ৪০ পেরোলেই যেমন চালশে ধরে, ভাবতে হয় চশমা নিয়ে তেমনই ভাবা উচিত পেনশন পরিকল্পনা নিয়েও। যাঁদের কর্মক্ষেত্রে পেনশনের সুবিধা নেই, তাঁদের অবশ্যই লগ্নি শুরু করা উচিত পেনশন প্রকল্পে। নানা ধরনের পেনশন প্রকল্প বাজারে এনেছে বিমা সংস্থা এবং মিউচুয়াল ফান্ডগুলি। এ ছাড়া আছে সরকারের নিউ পেনশন স্কিম বা এনপিএস। এসআইপি পদ্ধতিতে লগ্নি শুরু করা যেতে পারে এক বা একাধিক প্রকল্পে। টপ আপ-ও করা যাবে হাতে হঠাৎ কোনও বড় টাকা এলে। নিয়মিত লগ্নি করা যেতে পারে মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যালান্সড প্রকল্পেও।
অবসরের পরে টাকা রাখতে হবে অত্যন্ত গুছিয়ে। মাসিক ব্যয়ের নিরিখে টাকা রাখতে হবে উপযুক্ত মাসিক আয় প্রকল্পে। বাকি টাকা অন্য কোনও সুরক্ষিত প্রকল্পে। মাথায় রাখতে হবে করের ব্যাপারটিও। অবশ্যই থাকতে হবে উপযুক্ত স্বাস্থ্য বিমা। তা না-হলেই বিপদ। সঞ্চয় চালিয়ে যেতে হবে অবসরের পরেও। ভবিষ্যতের বাড়তি খরচ সামাল দেওয়ার জন্যই প্রয়োজন সঞ্চয়ের। ঝুঁকি যাঁদের ধাতে সয়, তাঁরা কম বয়স থেকে দুর্বল এবং অতি দুর্বল বাজারের সুযোগ নিয়ে অল্প অল্প করে ভাল শেয়ার সংগ্রহ করার অভ্যাস করতে পারেন। এতে কম লগ্নিতে গড়ে উঠতে পারে বিরাট সম্পদ। মনে রাখতে হবে, ইক্যুইটি যে-লাভ এনে দিতে পারে, তা অন্য কোনও লগ্নি প্রকল্পের পক্ষে সম্ভব নয়।
সঞ্চয় ও লগ্নির অভ্যাস করতে পারেন বাড়ির মহিলারাও। উদ্বৃত্ত অর্থ একটু একটু করে সঞ্চয় করে গেলে সময়কালে তা বড় প্রয়োজন মেটাতে পারে। বিদেশে এবং দেশের কোনও কোনও অংশে বেড়াতে যাওয়া এখন বেশ খরচসাপেক্ষ। অনেক আগে থেকে খরচসাপেক্ষ বেড়ানোর পরিকল্পনা করে টাকা জমানো শুরু করলে সুবিধা হয়। স্বনিযুক্ত মানুষের কাছে নিয়মিত সঞ্চয় ও লগ্নি আবশ্যিক খরচের মধ্যে পড়ে। যাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি এবং পেনশনের সুবিধা নেই, তাঁদের শেষ জীবনের জন্য যথেষ্ট আর্থিক সম্পদ তৈরি করা অবশ্যকর্তব্য। এঁদের সঞ্চয় শুরু করতে হবে কর্মজীবনের শুরু থেকেই এবং তা চালিয়ে যেতে হবে সারা কর্মজীবন ধরে। ভাল মাপের একটি তহবিল গড়ে উঠলে শেষ জীবনে মানসিক চাপ অনেক কম থাকে। আর্থিক সুরক্ষা থাকলে অনেক সঙ্কটের মোকাবিলা সহজে করা যায়। |