লর্ডস থেকে হাজতে
ক্রিকেটের শাপমুক্তির লক্ষ্যে বেনজির সাজা
ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন দৃশ্য কখনও দেখা যায়নি। অপরাধী সাব্যস্ত তিন ক্রিকেটার আদালত থেকে বেরোচ্ছেন। আর তাঁদের ‘এসকর্ট’ করে নিয়ে যাচ্ছেন জেল অফিসাররা।
খানিক ক্ষণ আগে লন্ডনের সাউথওয়ার্ক ক্রাউন কোর্টে বিচারপতি জেরেমি কুক তাঁর রায় শুনিয়েছেন।
অপরাধী নম্বর ১: কলঙ্কিত লর্ডস টেস্টে পাক অধিনায়ক সলমন বাট। স্পট ফিক্সিংয়ে প্রধান অভিযুক্ত।
লর্ডসে জুয়াড়ির সঙ্গে যোগসাজশে মোটা টাকার বিনিময়ে তাঁর দুই পেসারকে দিয়ে তিনটে ‘নো বল’ করিয়েছিলেন। বিচারপতির মতে, যিনি কেলেঙ্কারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দু’বছর ছ’মাসের জেল।
অপরাধী নম্বর ২: পাক পেসার মহম্মদ আসিফ। তিনটে নো বলের একটা তাঁর করা। টাকা যে নিয়েছিলেন তা প্রমাণিত। এক বছরের কারাদণ্ড।
অপরাধী নম্বর ৩: পাক পেসার মহম্মদ আমের। তিনটে নো বলের দু’টো তিনি করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও প্রমাণিত টাকা নিয়ে গড়াপেটার অভিযোগ। কিন্তু একমাত্র তাঁরই জেল হচ্ছে না। যে হেতু আমের শেষ মুহূর্তে নিজের অপরাধ কবুল করেছেন। ছ’মাসের জন্য তরুণ অপরাধীদের প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হচ্ছে উনিশ বছরের দিগ্ভ্রষ্ট পেসারকে।
কেলেঙ্কারির পাণ্ডা: ‘নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ সংবাদপত্রের ‘স্টিং অপারেশন’-এ যে স্পট ফিক্সিং জাল ধরা পড়েছিল, তাতে জুয়াড়ি হিসেবে লর্ডসের ‘স্পট ফিক্সিং’ আয়োজন করেছিলেন মাজহার মজিদ। অভিযোগ প্রমাণিত। দু’বছর আট মাসের হাজতবাস। শেষ মুহূর্তে দোষ কবুল না করলে চার বছরের কারাদণ্ড হতে পারত।
বিচারপতি বলেছেন, অর্ধেক মেয়াদ জেলে কাটাতেই হবে বাটদের। তবে তার পরে তাঁদের আচার আচরণের দেখে ঠিক হবে, তাঁদের কোনও রকম ছাড় দেওয়া হবে কি না। অন্য দিকে, সলমন বাটের কৌঁসুলি জানিয়েছেন, তিন কলঙ্কিত ক্রিকেটারই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
বিচারপতি কুক যখন রায় শোনাচ্ছেন, তখন লন্ডনের সাউথওয়ার্ক ক্রাউন কোর্টে সংবাদমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে। আর সেই রায় জানাজানি হওয়ার পর ক্রিকেটবিশ্বে নতুন করে দাবি উঠেছে ক্রিকেটকে সম্পূর্ণ কলঙ্কমুক্ত করার। ইয়ান বোথাম যেমন বলছেন, ক্রিকেট-দুর্নীতির গভীরে যাওয়া উচিত আইসিসি-র। “আমার মনে হয় যেটা আজ দেখছি, সেটা হিমশৈলের কণা মাত্র,” বলেছেন বোথাম।
সঞ্জয় মঞ্জরেকরও বলছেন, তিন পাক ক্রিকেটারের শাস্তি হল। ঠিক আছে। কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে একই অপরাধের অভিযোগ উঠেছে, সেই সব ক্রিকেটারকে কি শাস্তি দেওয়া হবে? গড়াপেটার জাল তো ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বেই!


এর পর ক্রিকেট ভক্তরা চাঞ্চল্যকর ঘটনা দেখলে
ভাববেন এটা সত্যিই ঘটেছে? নাকি সাজানো ঘটনা?




সলমন বাট
• জেল আড়াই বছরের।
• জরিমানা প্রায় সাড়ে
২৪ লক্ষ টাকা।
মহম্মদ আসিফ
• জেল এক বছরের।
• জরিমানা প্রায় সাড়ে
৬ লক্ষ টাকা।
মহম্মদ আমের
• ‘ইয়ং অফেন্ডার্স’ প্রতিষ্ঠানে
ছ’মাস কাটানোর নির্দেশ।
• জরিমানা প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ।
 
নেপথ্যের ‘নায়ক’
মাজহার মজিদ
• ২ বছর ৮ মাসের জেল।
• ৪৫ লক্ষ টাকা জরিমানা।

লর্ডসের সেই কালা দিন
• ম্যাচের তৃতীয় ওভারের প্রথম বল।
আমেরের নো বল।
টিভিতে বোথাম: সচরাচর
এ রকম দেখা যায় না।
• দশম ওভারের শেষ বল।
এ বার আসিফ।
টিভিতে আথারটন: বেশ বড় বড়
নো বল হচ্ছে দেখছি।
• আমেরের তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বল।
মাইকেল হোল্ডিং: ওহ্!
ওটা কতটা বাইরে!
বোথাম: নেট বোলিং।

কলঙ্কিত আরও মুখ
মহম্মদ আজহারউদ্দিন
আজীবন নির্বাসন।
এখন কংগ্রেস সাংসদ।
সেলিম মালিক
আজীবন নির্বাসন। কিন্তু পরে পাক
ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান কোচ।
মনোজ প্রভাকর
পাঁচ বছরের নির্বাসন।
পরে রঞ্জি কোচ।

হ্যান্সি ক্রোনিয়ে
আজীবন নির্বাসন।
২০০২-এ বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
হার্শেল গিবস
ছ’মাসের নির্বাসন।
ফের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
অজয় জাডেজা
পাঁচ বছরের নির্বাসন,
তিন বছরের মধ্যে মুক্তি
টিভি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ।

শেন ওয়ার্ন ও মার্ক ওয়
নামমাত্র জরিমানা। ফের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

আর বিচারপতি কুক, যিনি লন্ডনের আদালতে বসে এ দিন ঐতিহাসিক রায় শোনালেন, তিনি চার অপরাধীর দিকে তাকিয়ে বলছেন, “এর পর ক্রিকেটে যখনই কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটবে, পয়সা দিয়ে খেলা দেখতে আসা ক্রিকেটভক্তরা সন্দেহের চোখে নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করবে, এটা কি সত্যি কোনও ঘটনা? নাকি গড়াপেটা
হয়েছে? সত্যিই কি আমরা ব্যাট-বলের আসল লড়াই দেখছি? নাকি আমাদের চোখের সামনে কোনও সাজানো ঘটনা মঞ্চস্থ হচ্ছে?”
সব মিলিয়ে, লন্ডনের আদালত তিন পাক ক্রিকেটারকে নজিরবিহীন শাস্তি দেওয়ার দিনে ক্রিকেটকে ঘিরে ফের সেই সন্দেহের বাতাবরণ। ডব্লিউ ডব্লিউ এফ-এর মতো শুধুই সাজানো লড়াই নাকি সত্যিই রক্তমাংসের ক্রিকেট? একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠে পড়েছে আইসিসি এবং তাদের গোয়েন্দা দফতরের যোগ্যতা নিয়ে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সংবাদপত্রের গোপন ক্যামেরা অভিযানে নজিরবিহীন একটা রায় ঘোষিত হল। আইসিসি গোয়েন্দারা সব ম্যাচে উপস্থিত থেকেও কাউকে ধরতে পারেন না কেন? বিশেষ করে যেখানে গড়াপেটার উপস্থিতি নিয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই।
লর্ডসের সেই কুখ্যাত টেস্ট ম্যাচে আমের-রা যখন নো বল করে যাচ্ছেন, তখন কমেন্ট্রি বক্সে ছিলেন বোথাম। তখনই ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এত বড় বড় নো বল করাটা বিস্ময়কর। জুয়ার উপার্জনে ক্রিকেট কলঙ্কিত হওয়ার দিনে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অলরাউন্ডারেরও দাবি, আইসিসি গোয়েন্দাদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার সময় হয়েছে। “দিনের শেষে ওরাই তো ক্রিকেটের পুলিশ। আমরা প্রত্যেকে জানি মহামারীর মতো গড়াপেটার রোগ চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আইসিসি-র হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।”
এগারো বছর আগে দিল্লি পুলিশের জালে হ্যান্সি ক্রোনিয়ে ধরা পড়ার পর ক্রিকেট নিয়ে একই রকম অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। তখন সিবিআই তদন্তে মহম্মদ আজহারউদ্দিন, অজয় জাডেজা-সহ একাধিক ভারতীয় তারকা ক্রিকেটার দোষী সাব্যস্ত হন। ঘটনা হচ্ছে, এত কাল ম্যাচ গড়াপেটায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ক্রিকেট বোর্ড বা আইসিসি কর্তৃক শাস্তির ঘটনা ছিল। আজহার বা ক্রোনিয়েই যেমন আজীবন ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্বাসনের শাস্তি শুনিয়েছিল তাঁদের দেশের ক্রিকেট বোর্ড। আদালতে গড়াপেটার মামলা চলে ক্রিকেটারদের হাজতবাসের রায় এই প্রথম।
ঐতিহাসিক রায়ের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটমহল ফিরে তাকাচ্ছে ক্রোনিয়ে-কাণ্ডের দিকে। ২০১১-তে লন্ডন যেটা করে দেখাল, ২০০০-এ দিল্লি সেটা কেন পারল না?
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অরুণাভ ঘোষের ব্যাখ্যা, “লন্ডনের পুলিশ সলমন বাটদের নিয়ে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট জমা দিয়েছে। আমি যত দূর সংবাদপত্র পড়ে জেনেছি, দিল্লি পুলিশ সেটা করেনি। চার্জশিট জমা না দিলে কী করে আদালতে অপরাধীর শাস্তি হবে?” ভারতীয় আইনবিধিতে সেই সময় হ্যান্সি ক্রোনিয়ে বা হার্শেল গিবসকে আদালতে শাস্তি দেওয়া যেত কি না জানতে চাইলে অরুণাভবাবু যোগ করলেন, “দর্শকরা তো টাকা দিয়ে টিকিট কেটে খেলা দেখতে আসছে। সত্যিকারের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য পয়সা খরচ করছে। সেখানে যদি একটা ফিক্সড ম্যাচ কেউ করে, সে তো দর্শকদের ঠকাচ্ছে। প্রতারণার মামলা তো তার বা তাদের বিরুদ্ধে করা যেতেই পারে। তার পর অবশ্যই শাস্তির প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু চার্জশিটই যদি না জমা পড়ে তা হলে আদালতে কী করে শাস্তি হবে?”
দিল্লি পারেনি। কিন্তু লন্ডন আরও কয়েক জনকে ধরতে পারে খবর। যেমন আর এক পাক পেসার ওয়াহাব রিয়াজ। লর্ডসগেটে তাঁর নামও জড়িয়েছিল। মাজহার মজিদ জুয়ার টাকা এনে রিয়াজকেই দিয়েছিল বলে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এ ছবিও বেরিয়েছিল। রিয়াজ একটা জ্যাকেট পরে ছিলেন এবং দু’জন লোক এসে তাঁর জ্যাকেটে টাকা ভরে দিয়ে চলে যায়। আদালতে বলা হয়েছে, সে দিন লন্ডনে বেশ গরম ছিল। জ্যাকেট গায়ে দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। রিয়াজের গায়ে জ্যাকেট থাকলেও দেখা গিয়েছিল হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। রিয়াজকে লন্ডন পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়নি। তাৎপর্যের ব্যাপার হচ্ছে, রিয়াজকে গত কালই পাকিস্তান দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদালতে কামরান আকমলের নামও উঠেছে বলে খবর।
শাহিদ আফ্রিদি যাঁকে সরিয়ে সলমন বাটকে অধিনায়ক করা হয়েছিল তিনি বলেছেন, “সবাই জানে ইংল্যান্ডে এই ঘটনার জন্য আমাদের সকলকে কী রকম অসম্মানিত হতে হয়েছিল। এটা আমাদের কাছে একটা শিক্ষা। আমি শাস্তি পাওয়া ক্রিকেটারদের পরিবারের জন্য দুঃখিত। এটা এমন একটা কলঙ্ক যে সারা জীবন ওদের সঙ্গে থেকে যাবে।”
বাটদের হাজতবাসেই কি পাকড়াও অভিযান শেষ হয়ে যাবে? নাকি বোথামদের দাবি মতো সত্যিই ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করার চেষ্টা হবে? রশিদ লতিফের মতো প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার নিশ্চিত হতে পারছেন না। আইসিসি-কে চিঠি লিখে লতিফ জানিয়েছেন, আমার মনে হয় না এতে পাকিস্তান ক্রিকেট বা বিশ্বক্রিকেটে কোনও পার্থক্য ঘটবে। পাকিস্তান টিম থেকে কয়েক জন বাদ পড়বে ঠিকই। কিন্তু তাদের জায়গায় অন্য দুর্নীতিগ্রস্ত ক্রিকেটারেরা ঠিকই চলে আসবে।

(সহ প্রতিবেদন: শ্রাবণী বসু)




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.