কথায়-কথায় রেলপথ ও সড়কপথ অবরোধ করিয়া প্রতিবাদ-জ্ঞাপন কিংবা প্রশাসনের কাছ হইতে সুযোগসুবিধা আদায় করার প্রবণতাটি এখন জাতীয় রাজনীতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সম্প্রতি কিষানগঞ্জের কাছে স্থানীয় দাবিতে দীর্ঘ বারো ঘণ্টার যে রেল-অবরোধ হয়, তাহাতে স্বয়ং রেলমন্ত্রী পর্যন্ত আটকাইয়া পড়েন, উত্তরবঙ্গের সহিত অবশিষ্ট দেশের রেল-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। আবার মহারাষ্ট্রের একটি লেভেল-ক্রসিং বেআইনি ভাবে পার হইতে গিয়া মালগাড়ির ধাক্কায় একটি খড়বাহী ট্র্যাক্টরের দুই আরোহীর মৃত্যু হইলে দিল্লি-মুম্বই রেল-সংযোগ দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থাকে। কিন্তু অবরোধের যাবতীয় রেকর্ডকে বোধ করি ভাঙিয়া দিয়াছে মণিপুরে যথাক্রমে ২ ও ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়কের নব্বই দিন ব্যাপী অবরোধ। দাবি: কুকি জনগোষ্ঠীর জন্য সদর হিল্স এলাকায় একটি পৃথক জেলা গঠন। রাজ্য সরকারের এই দাবিটি শিরোধার্য করিতে তিন মাস লাগিয়া গিয়াছে। এই তিন মাস মণিপুরে সড়ক যোগে অত্যাবশ্যক পণ্যের সরবরাহ বন্ধ থাকিয়াছে।
সরকার যখন কুকিদের দাবি শেষাবধি মানিয়াই লইলেন, তখন তিন মাস ধরিয়া মণিপুরবাসীদের অবরোধজনিত যন্ত্রণা সহ্য করিতে হইল কেন, সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রশ্ন তুলিয়াছে। শীর্ষ আদালত আর একটি প্রশ্নও তুলিয়াছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির প্রতি চিরাচরিত অবহেলা ও উপেক্ষার মাসুলই কি এই ভাবে সেখানকার জনসাধারণকে গনিতে হইতেছে? প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ, কেননা দেশের অন্য কোনও রাজ্যে তিন মাস ধরিয়া কোনও জাতীয় সড়ক অবরোধ করিয়া রাখিতে দেওয়া হইত না। জাতীয় সড়ক বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে জীবন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং এক প্রান্তের পণ্যসামগ্রী অন্য প্রান্তে পৌঁছাইয়া দেওয়ার মাধ্যম। তাই জাতীয় সড়কের অবরোধ কার্যত সেই সব রাজ্যের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের চেহারা পরিগ্রহ করে। মণিপুরের জনসাধারণ তাঁহাদের প্রতিটি অত্যাবশ্যক সামগ্রীর সরবরাহের জন্য জাতীয় সড়কের উপরেই নির্ভরশীল। দিল্লি-মুম্বই কিংবা কলিকাতা-মুম্বই জাতীয় সড়ক কি এ ভাবে তিন মাস বন্ধ রাখা যাইত? সরকার কি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হস্তক্ষেপ করিয়া অবরোধ উঠাইয়া দিত না, বুঝাইয়া-সুঝাইয়া না-হোক, অন্তত গায়ের জোরে? মণিপুর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক রাজ্য বলিয়াই সেখানকার জ্বলন্ত সমস্যার প্রতি এমন ঔদাসীন্য সম্ভব হইয়াছে।
একই রকম ঔদাসীন্য কেন্দ্র তথা মূল ভূখণ্ডের রাজনীতিকদের তরফে লক্ষ করা যায় নাগা, বড়ো, ত্রিপুরি বা আল্ফা বিদ্রোহের নিরসনে তৎপরতাহীনতায়। এন এস সি এন-এর সহিত শান্তি-আলোচনা কত কাল ধরিয়া চলিতেছে? আল্ফার সহিত আলোচনার প্রক্রিয়াও সবে শুরু হইয়াছে। নাগা শান্তি-আলোচনার হাল-হকিকত দেখিয়া আল্ফা নেতৃত্ব আগেই সতর্ক করিয়াছে, এত দীর্ঘমেয়াদি ও নিষ্ফল আলোচনার উপর্যুপরিতায় তাহাদের আস্থা নাই। আর মণিপুরের জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তো দেখিতে-দেখিতে দুই ডজন সংগঠনে বিভাজিত। যে-কোনও শান্তি-আলোচনা শুরু করিতে সেখানে এতগুলি গোষ্ঠীকে সম্মত করাইতে হইবে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আর্থিক উন্নয়নের প্রশ্নেও কেন্দ্রের একই রকম ঢিলেমি ও দায়সারা, গয়ং-গচ্ছ মনোভাব বারংবার প্রকাশিত। সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন ও উপদ্রুত এলাকা আইনের মতো দমনমূলক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নেও দিল্লির দ্বিধা ও দোলাচল সেখানে অশান্তি ও অরাজকতাকে স্থায়িত্ব দিতেছে। জাতীয় সংহতির কিছু দায় আছে বইকী। |