বিপ্লব নাকি তার সন্তানদের গ্রাস করে। বিপ্লব কি তার প্রচারমাধ্যমকেও গ্রাস করে? আরব-বসন্তের প্রসারে
বহু বিতর্কিত গণমাধ্যম আল জাজিরা-র বড় ভূমিকা ছিল। তার স্বাধীনতাও কি এ বার খর্ব হওয়ার পথে?
সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায় |
মাস দেড়েক আগেই আরব দুনিয়াতে ঘটে গিয়েছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বরখাস্ত হয়েছেন বহুবিতর্কিত টিভি চ্যানেল আল-জাজিরার ডিরেক্টর জেনারেল ওয়াদা খানকার। তাঁর আসনে বসানো হয়েছে কাতারের শাসক আমির পরিবারের শেখ আহমেদ বিন জাসিম আল খান’কে। ইতিপূর্বে তিনি কাতার গ্যাস কোম্পানির অধিকর্তা ছিলেন। জন্মসূত্রে প্যালেস্তাইনি ওয়াদা খানকার বিগত আট বছর ধরে চ্যানেলকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেন।
গত ডিসেম্বর থেকে আরব দুনিয়ায় যে জনবিদ্রোহ ছড়াতে থাকে, তাতে আল-জাজিরার ভূমিকা বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর এক যুবক গায়ে আগুন দিয়ে মরার পর যে বিক্ষোভ শুরু হয় টিউনিসিয়ায়, তার আগেই ওই দেশে আল-জাজিরার ব্যুরো অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানবাধিকার কর্মী লতফি হাজ্জির মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবি দিয়েই ওই চ্যানেল ‘সিদ্দি বওজিদ বিদ্রোহ’ নিয়ে তাদের ধারাভাষ্য শুরু করে। সেই সংবাদ ক্রমে মিশর, বাহরিন, সিরিয়া, লিবিয়া সর্বত্র পালাবদলের ইন্ধন জোগায়। তহরির স্কোয়ারে বিক্ষোভের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খবর দিয়েছে আল-জাজিরা। বিক্ষোভের এক মাস আগে হোসনি মুবারক কাতারে গিয়ে আমিরের সঙ্গে দেখা করেন। প্রসঙ্গত, ২০০০-এ কাতার সফরে গিয়ে মুবারক বিনা নোটিসে আল-জাজিরা দফতরে যান। সংবাদ বিভাগটি ঘুরে মন্তব্য করেন, এইটুকু দেশলাই বাক্সে এত আগুন ধরে! |
ওয়াদা খানকারের বিরুদ্ধে অঘোষিত যে-সব অভিযোগ, তাতে প্রথমেই বিন লাদেন প্রসঙ্গ। ৯/১১-র পর ওসামা যখন বিবিসি-র নাগালেরও বাইরে, তখন দিনের পর দিন কেন এই চ্যানেলে তার সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়েছে? পরের কথা, লিবিয়ায় যখন গোলমেলে অবস্থা, তখন কাতারে আত্মগোপনকারী ইসলামি ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিকে কেন পর্দায় হাজির করা হল? প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েলের মধ্যে গোপন চুক্তি হওয়ার আগেই কেন সেই সংবাদ চলে এল টিভি-র পর্দায়? যে কাতার সরকারের টাকায় চ্যানেলটি চলে, তার প্রায় কোনও খবরই কেন আল-জাজিরায় থাকে না? পদত্যাগপত্রে খানকার জানিয়েছেন, আল-জাজিরা আরব দুনিয়ায় সাংবাদিকতার যে দিগন্ত উন্মোচন করেছে, তা দিনে দিনে প্রসারিত হবে।
১৯৯৬ সালের ১ নভেম্বর আল-জাজিরার সম্প্রচার শুরু। তার পর থেকে এই চ্যানেল বার-বার আক্রান্ত হয়েছে দু’দিক থেকে। আরব দুনিয়ায় এমন দেশ নেই যে এই চ্যানেলের সমালোচনা করেনি। কাতারের প্রধানমন্ত্রীও এক সময় বলেছেন, ওই বাড়িটাই তাঁর সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। একই ভাবে চ্যানেলকে আক্রমণ করেছে নেটো-র দেশগুলি।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত কাতার ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। তার পর থেকে চলছে আমিরশাহি। বর্তমান আমির শেখ হামাদ বিন খালিফা আল থানি পিতাকে গদিচ্যুত করে ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৫ সালে। ব্রিটিশ মিলিটারি আকাদেমিতে শিক্ষণপ্রাপ্ত এই আমিরের দ্বিতীয় পত্নী শেখ মাজা বিন নাসের আল-মিসনেদ, যিনি আমেরিকায় উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত এবং একদা ইউনেস্কোর দূত। এই দম্পতি নারীশিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন, আল-জাজিরার মতো একটি চ্যানেল উপহার দিয়েছেন। মকবুল ফিদা হুসেন যখন ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব দিয়েছে কাতার।
এখন অবস্থাটা এমনই যে, আসলে দেশটার নাম আল-জাজিরা, তার রাজধানী হল কাতার। এটা এক দিনে হয়নি। লিবিয়ার কথাই ধরা যাক। ২০০০ সালে প্রচারিত একটি তথ্যচিত্রে জানানো হয়, লিবিয়ায় গণ-কমিটি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটাই ভ্রান্ত, কারণ সেখানে গদ্দাফির অনুগামী ছাড়া আর কারও ঢোকারই কোনও রাস্তা নেই। এই সম্প্রচারের পর লিবিয়া কাতার থেকে দূত প্রত্যাহার করে নেয়। কাতার সরকার জানায়, ওই মত একান্তই আল-জাজিরার, কখনওই কাতার সরকারের নয়। গদ্দাফি অবশ্য চ্যানেলে মুখ দেখানো বন্ধ করেননি।
২০০১ সালের অক্টোবরে নেটো-বাহিনী আফগানিস্তান আক্রমণ করে। এক মাসের মধ্যে চ্যানেলের কাবুল অফিস বোমায় ধ্বংস হয়। দৃশ্যত, সেই আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিলেন সাংবাদিক তায়সের আলুনি। তিনিই নিয়মিত বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিতেন।
বিন লাদেনের দৃষ্টান্ত তুলে আল-জাজিরাকে যখন ইসলামি মৌলবাদের প্রচারক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই সময়েই একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, যার নাম ‘নাস্তিকের কোরান পাঠ’। সৌদি আরব থেকে বহিষ্কৃত এক গবেষক সেখানে জানান, ওই দেশে ইসলামের মর্মবাণী কী ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। অ্যারাব স্টেটস ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন আল-জাজিরার সদস্যপদ বাতিল করে। গোটা সৌদিতে ‘জ্যাম’ করা হয় চ্যানেলের সম্প্রচার।
ওয়াদা খানকারকে যখন বরখাস্ত করা হল, তখন আরব দুনিয়ায় বসন্ত বাতাস কতখানি প্রবল? লিবিয়ায় গদ্দাফি-নিধন হলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার হাল কে ধরবে তার ঠিক নেই। ইরাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর তহরির স্কোয়ার? মিশরে সুপ্রিম কাউন্সিল অব আর্মড ফোর্সেস ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ডিক্রিতেই বলা হয়েছে, দেশে ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ নিষিদ্ধ। কায়রোয় ইজরায়েল দূতাবাসে বিক্ষোভকে অজুহাত হিসেবে ধরে দেশে জরুরি অবস্থা জারি। সমরকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী জুনের আগে কোনও নির্বাচন নয়। ইতিমধ্যে সারা দেশে ১২ হাজার মানুষ কারাবন্দি। হোসনি মুবারক তাঁর ৩০ বছরের শাসনকালে এত মানুষকে জেলে ঢোকায়নি। সৌদি আরবের রাজা মহিলাদের ভোটাধিকার দিতে চেয়েছেন, তবে তা কার্যকর হবে চার বছর পরে। ইরানে জাফর পানাহির মতো বিশ্রুত পরিচালক কারারুদ্ধ।
কিন্তু কাতারের আমির কোন বিবেচনায় আল-জাজিরাকে এতখানি স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন? আসলে কাতার একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ, যাকে গ্রাস করার জন্য দু’দিকে আছে দু’টি বৃহৎ শক্তি: সৌদি আরব এবং ইরান। গিলে যে খায়নি, তার কারণ গোটা পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার এত বড় সেনা-ছাউনি আর কোথাও নেই, এমনকি সৌদি আরবেও নয়। ২০০৩ সালে কাতারের আল-উদেইন বিমানক্ষেত্র থেকেই ইরাকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। কাতারে গণতন্ত্র নেই, আমিরই শেষ কথা। আল-জাজিরাও চলেছে আমিরের মর্জিতেই।
সাদ্দাম হোসেন, বিন লাদেন, হোসনি মুবারক বা গদ্দাফির পরিণতি দেখে কি সতর্ক হলেন কাতারের আমির? তা হলে বলতেই হবে, আরব বসন্তের অন্তিম পর্বে বেদনাময় শহিদ হল আল-জাজিরা এবং তার কর্ণধার ওয়াদা খানকার।
দূরদর্শনের প্রাক্তন সংবাদ প্রযোজক |